বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
আগুনঝরা মার্চ

২৩ মার্চ পাকিস্তান অধ্যায়ের যবনিকাপাত

নূরে আলম সিদ্দিকী

২৩ মার্চ পাকিস্তান অধ্যায়ের যবনিকাপাত

২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন দিবস। এটা ইতিহাস স্বীকৃত বাস্তব।

বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, এ পতাকাটি যতদিন আপন মহিমায় গৌরবদীপ্ত ভঙ্গিমায় বাঙালির সুতীব্র আবেগের আবির মাখিয়ে উড্ডীয়মান থাকবে—            

ততদিন দিগন্তবিস্তীর্ণ আকাশের বক্ষে প্রদীপ্ত সূর্যের মতো শাশ্বত এবং স্মরণীয় থাকবে। ২৩ মার্চ ছিল লাহোর প্রস্তাব দিবস বা পাকিস্তান দিবস। ওইদিন ইসলামাবাদে রাষ্ট্রপতি এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর উড্ডীয়মান পাকিস্তানের পতাকাখচিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করতেন। এ দিনটিতেই আমরা পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলনের নির্দেশনা প্রদান করি। এর আগের দিন ২২ মার্চ গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত বিবৃতি প্রদান করি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (পূর্বের ইকবাল হল) স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ছিল বলেই প্রায় সার্বক্ষণিক দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম কর্মীদের পদচারণায় মুখর থাকত। এটা নতুন প্রজন্মের অবগতির জন্য উল্লেখ্য যে, আমাদের আন্দোলনের মূল স্থপতি বঙ্গবন্ধু ছিলেন। ২৩ মার্চে পতাকা উত্তোলনের নির্দেশটি তারই কাছ থেকে আসা। এবং ২৩ মার্চ তারই অভিবাদন গ্রহণ করা বাহ্যত সঙ্গত ছিল কিন্তু সেটি হয়নি। কেননা, তিনি ওইদিন অভিবাদন গ্রহণ করলে ঘুরেফিরে বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদটি তার স্কন্ধে বর্তাত। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃ-চতুষ্টয়ের অভিবাদন গ্রহণ সন্দেহাতীতভাবে আবারও প্রমাণ করল আমাদের প্রাণের মুজিব ভাই, স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মননশীলতা ও মানসিকতা, প্রতীতি ও প্রত্যয়, আদর্শ ও চেতনা তো বটেই; ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর অবয়বেরও প্রতিনিধিত্ব করত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। বলা বাহুল্য, এসব সিদ্ধান্ত একমাত্র বঙ্গবন্ধুর সম্মতিতেই আমরা গ্রহণ করতাম।

পূর্ব-নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সারা বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকাটি সগৌরবে উড়িয়ে দেয় এদেশের স্বাধীনতা-পাগল মানুষ। আনুষ্ঠানিকভাবে পল্টন ময়দানে আমরা চারজন মঞ্চে দাঁড়াই অভিবাদন গ্রহণের জন্য এবং খসরু, মন্টু, সেলিম, সম্ভবত হাসানুল হক ইনুও সঙ্গে ছিলেন। বিউগলে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে পতাকাটি উড়ল আর শুরু হলো একেকটি ব্রিগেডের অভিবাদন দেওয়ার অভিযাত্রা। ৩০৩ রাইফেল থেকে উপর্যুপরি আকাশের দিকে গুলিবর্ষণ হতে লাগল। তখন আউটার স্টেডিয়ামটি ছিল না। যতদূর চোখ যায়, সীমাহীন সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত উর্মিমালার মতো মানুষ আর মানুষ। কর্মসূচি অনুযায়ী আমরা ওই ব্রিগেড ও স্বতঃস্ফূর্ত জনতাকে নিয়ে মার্চপাস্ট করে ৩২ নম্বরে গিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর হাতে পতাকাটি তুলে দিই। পতাকাটি গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা স্লোগানটি প্রদান করেন। লাখো জনতার কণ্ঠ হতে জয় বাংলা স্লোগানটি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ইথারে ভাসতে ভাসতে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১১ সালের ২৩ মার্চ রাজমনি হোটেলের অডিটরিয়ামে আবদুর রাজ্জাক প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বিস্তারিত বিশ্লেষণসহ প্রতিস্থাপিত করেন যে, তিনি সেদিন ৩২ নম্বরে উপস্থিত ছিলেন এবং আমি যে বঙ্গবন্ধুর হাতে পতাকাটি তুলে দিই রাজ্জাক ভাইয়ের সেদিনের বক্তব্যসহ বিভিন্ন সময়ে সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখের বক্তৃতায় বারবার ঘটনাটি উঠে আসে। এর সবগুলোর টেপরেকর্ডই ইতিহাসের প্রয়োজনে প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। এবারের মার্চ মাসে বেদনাহত চিত্তে লক্ষ্য করলাম, সংবাদপত্রসমূহে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মকাণ্ডকে প্রায় বিস্মৃতই করে ফেলেছে। কোনো কোনো পত্রিকায় এমন প্রয়াসও পরিলক্ষিত হয়েছে যে, মূলত ছাত্র ইউনিয়নই মার্চের সব কর্মসূচির উদ্যোক্তা ছিল ও অগ্রভাগে ছিল! ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এ আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে থেকে মুখ্য ভূমিকা তো দূরে থাক, আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিল কিনা নতুন প্রজন্মের পাঠক-পাঠিকারা তা অনুধাবনই করতে পারবে না। অবশ্য বৈদ্যুতিক গণমাধ্যমগুলোতে এর কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা গেছে।

আজকে যারা সুপরিকল্পিতভাবে ছাত্র ইউনিয়নকে স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনের সিংহভাগ কৃতিত্ব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেতভাবে প্রদান করার অপচেষ্টায় ব্যাপৃত, তাদের এ অভিলাষ এবং অভিপ্রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে ২৩ মার্চের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে চাই। বাঙালির জাতীয় চেতনার উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার আন্দোলনের সোপানগুলোয় ছাত্রলীগই একেকটি আন্দোলনের সফলতার মধ্য দিয়ে এর ব্যাপ্তি ও বিকাশ ঘটিয়েছে। প্রতিটি স্তরের জাগ্রত জনতার মানসিকতায়, তাদের হৃদয়ের ক্যানভাসে বাঙালি সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে শুধু হাল ধরা নয়, ক্রমান্বয়ে তাদের উচ্চারণ করতে হয়েছে— ‘তুমি কে, আমি কে? বাঙালি বাঙালি’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’।

বাঙালির হৃদয়স্পর্শী এসব স্লোগান উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত রোমান্টিক বামদের (মস্কো, পিকিং উভয়ই) কতইনা কটাক্ষ ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমাদের প্রাণের মুজিব ভাইকে তারা ভারতের চর, সিআই’র দালাল বলে গালাগাল করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। ক্ষেত্রবিশেষে এনএসএফ ও ইসলামী ছাত্রসংঘের চাইতেও তাদের বক্তব্য ছিল নেতিবাচক ও আক্রমণাত্মক। ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ক্রমেই এ বিরোধ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুজিব ভাই ছয় দফা প্রদানের পর আমাদের স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার আন্দোলনে পদার্পণের মুহূর্তে তারা আমাদের এতটাই সমালোচনা করে যে, সিআই’র দালাল ও ভারতের চর তো বলতই, এমনকি তাদের রাজনৈতিক সংগঠন ন্যাপের নেতারা ছয় দফা প্রদানের মাধ্যমে স্বাধীনতার উপক্রমণিকা ও প্রচ্ছন্ন প্রচ্ছদপট হিসেবে আমরা যেমন বিশ্বাস করতাম, তারাও তেমনি বিশ্বাস করে প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছিল। মশিউর রহমান যাদু মিয়া এমনকি সংসদে মুজিব ভাই’র মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দাবি করেছিলেন।

স্বপ্নবিলাসী বিপ্লবীরা আমাদের যখন প্রতিক্রিয়াশীল বলে গালাগাল করতেন, আমরা ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সীমানা অতিক্রম করতে পারি না— এ তির্যক কটাক্ষ করতেন, তখন আমরা, বিশেষ করে আমি সারা বাংলাদেশে বাউলের মতো বাঙালির ঐতিহ্য, তার মননশীলতা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য তিল তিল করে তুলে ধরে বলতাম— ‘এ মাটি আমার সোনা, আমি করি তার জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা’, ‘সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি, যে আছে মাটির কাছাকাছি’, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। আমার কণ্ঠে বজ্র নির্ঘোষে বাংলার প্রতিটি কন্দরে কন্দরে উচ্চারিত হতো— ‘লেনিন, স্ট্যালিন, চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রো বা মাও সে তুংকে আমি অশ্রদ্ধা করি না। কিন্তু বাংলার দোআঁশ মাটির অপূর্ব গন্ধ আমাকে বিমোহিত করে, খররৌদ্রে হালচাষ করা কৃষকের বুক-নিঃসৃত ঘাম আমার চিত্তকে উদ্বেলিত করে, দুর্গন্ধময় পানিতে দাঁড়িয়ে পাট-কাচা কৃষকের গায়ের গন্ধ আমার চিরায়ত সত্তার উৎস। যে গ্রাম্য জননী মাঝরাতে উঠে ধান সিদ্ধ করে, ঢেঁকিতে পাড় দেয়, জর্দা দিয়ে পান খেয়ে পিক ফেলে, শহরের প্রসাধনী নয়, পূতপবিত্র বাংলার মাটি গায়ে মেখে গোসল করে, ঘোরতর খররৌদ্রে উঠোনে ধান শুকায়— সেই গ্রাম্য বালাকে মা বলে ডাকতে পারি বলেই, আমার নেতা লেনিন, স্ট্যালিন, চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রো বা মাও সেতুং নয়; আমার নেতা শেরেবাংলা, আমার নেতা সোহরাওয়ার্দী, আমার নেতা শেখ মুজিব। পেন্টাগন, ক্রেমলিন বা দিল্লির শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে নয়, শেখ মুজিবের একক নেতৃত্বে আমরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে হলেও পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবই।’

২৩ মার্চের এ নিবন্ধে সত্যের খাতিরে আমাকে উল্লেখ করতেই হয়, শেখ মুজিবের একক নেতৃত্ব হবে কীভাবে? তার জন্য একটি গণম্যান্ডেট দরকার। ৬৬-এর ৭ জুন মনু মিয়ার রক্তস্রোত থেকে বাংলাদেশ দৃপ্তশপথে উজ্জীবিত হয়— আজ আর স্বাধিকারের কথা নয়, আমরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা চাই এবং তার সনদ ছয় দফা। অতি সংক্ষেপে বিবৃত করা যায়, মুজিব ভাই থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের প্রায় সব শীর্ষ নেতাকে এবং ছাত্রলীগের শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, আল মুজাহিদীকে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। সৌভাগ্য আমার, ৬৬-এর ৭ জুনের পর গ্রেফতারকৃত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আমিই ছিলাম প্রথম। পরে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়। ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ মিছিলটি বের করে জগন্নাথ কলেজ। সঙ্গে তখনকার কায়েদে আযম কলেজ। এই বিশাল দৃপ্ত মিছিলের নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের কাজী ফিরোজ, এম এ রেজা, সাইফুদ্দিন, মফিজ, ছাত্র ইউনিয়নের ইয়াকুব। যার ফলশ্রুতিতে তারাও সবাই কারারুদ্ধ হন। বিস্তৃত বিবরণে না গিয়ে বলতে হয়, দীর্ঘদিন পর ৬৯-এর গণআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়। যখন ঢাকা শহর আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো বিস্ফোরিত হয়, তখন লৌহমানবখ্যাত আইয়ুব খানকে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে হয়। ৬৯-এর ফেব্রুয়ারি মাসের ১১ তারিখ আমরা মুক্তি পাই। বঙ্গবন্ধু অবমুক্ত হন ২১ তারিখে। ইতিহাসকে সম্মান করি বলেই আমি দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করব ১১ দফার সংগ্রাম কমিটি সর্বদলীয় হলেও, ছাত্রলীগের মরহুম আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী ও তোফায়েল আহমেদের ভূমিকাই মুখ্য ছিল। ১১ দফা প্রণয়ন (ড্রাফট) করেন আবদুর রউফ। ১১ দফায় ছয় দফাকে সম্পূর্ণ অবিকৃত রেখে সম্পৃক্ত করার কৃতিত্বও ছাত্রলীগ নেতৃত্বের। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম, বাঙালি জাতীয় চেতনার একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগেও সশস্ত্র বিপ্লবের মননশীলতায় একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তারা কার্ল মার্ক্স, লেনিন, স্ট্যালিন, চে গুয়েভারাকেও যেন ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাদের চেতনার ধ্রুবতারা ছিল রেজিস দেব্রে। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিপ্লবের মধ্যে বিপ্লব (revolution within revolution)। রেজিস দেব্রে বিশ্বাস করতেন, সশস্ত্র বিপ্লব কখনো থেমে থাকে না। সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালার মতো একটি তরঙ্গ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আরেকটি তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। এ মননশীলতায় বিশ্বাসীদের কাছে নির্বাচন অর্থহীন এবং হাস্যকর। ৭০-এর নির্বাচনকে তারা পাত্তাই দিতে চাননি। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’— এটিই ছিল তাদের চিন্তার প্রতিপাদ্য। তাদের স্লোগান ছিল— ‘বাংলার অপর নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’, ‘বিপ্লব বিপ্লব, সশস্ত্র বিপ্লব’ ‘নির্বাচনের কথা বলে যারা, ইয়াহিয়া খানের দালাল তারা’, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।

আজকেও আমি ভাবলে শিউরে উঠি, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সশস্ত্র বিপ্লবীদের উচ্চকিত স্লোগানের ফলশ্রুতিতে ৭০-এর নির্বাচনটি যদি আমরা করতে না পারতাম, তাহলে বঙ্গবন্ধু গণম্যান্ডেটটি পেতেন কোথা হতে? ৭০-এর নির্বাচন বঙ্গবন্ধুকে একক নেতৃত্বেই অধিষ্ঠিত করেনি, তাকে বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের মূল কর্ণধারের অধিকার প্রদান করে এবং এ লক্ষ্যে যে কোনো কর্মসূচি গ্রহণের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা এবং বৈধতা আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে ন্যস্ত করে। এ সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে আমাদের মনস্তাত্ত্বিক চেতনার বিভাজনের বিস্তীর্ণ বিবরণ নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করবে।

স্বাধীনতা অর্জনে সশস্ত্র বিপ্লব ও নির্বাচনের প্রশ্নে দুটি ধারা থাকলেও স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশ্নে কোনো বিভাজন ছিল না। তাই ৭০-এর নির্বাচনে আমরা নিরঙ্কুশ জয়টি নিতে পেরেছিলাম এবং বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বের একক কর্তৃত্ব লাভ করেছিলেন। এটি আমাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত। তবুও আধিপত্যবাদী পাকিস্তানি শক্তি তাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার নেশায় নির্বাচনের গণম্যান্ডেট ও বঙ্গবন্ধুর কর্তৃত্বকে মেনে নিতে পারেনি বলেই ৩ মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষিত করে। ১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং ২ মার্চ, ৩ মার্চ, ২৩ মার্চ এবং ২৬ মার্চে স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা একই ধারাবাহিকতার ফসল। নির্বাচনের ম্যান্ডেট-বিবর্জিত বঙ্গবন্ধুর যে কোনো ডাক শ্রীলঙ্কার এলটিটি, পাঞ্জাবের খালিস্তান, সেভেন সিস্টারসহ পৃথিবীর বহু দেশের ব্যর্থ আন্দোলনের মতোই বিচ্ছিন্নতাবাদের আখ্যা পেয়ে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতো। নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস ম্যান্ডেট-বিবর্জিত হওয়ার পরও বৈপ্লবিক চেতনার মহাপুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন কিন্তু স্বাধীনতা এসেছে কংগ্রেসের হাত ধরে নির্বাচনের ম্যান্ডেট নিয়েই। এ নিবন্ধে আমি আর কোনো উদাহরণ টানতে চাই না।

আজকের এ ঘনঘোর অমানিশার মধ্যে আমার গৌরবের দিকটি উচ্চকিত কণ্ঠে তুলে ধরতে চাই। সংবাদমাধ্যমগুলো যেভাবেই উত্তাল মার্চের দিনগুলোকে তুলে ধরুক না কেন, সূর্যালোকের মতো সত্য যে, বঙ্গবন্ধু শুধু আমাদের নির্দেশকই ছিলেন না, তিনি আমাদের কথা শুনতেন, আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করতেন। বোধ করি সেজন্যই দেশের মানুষ আমাদের চারজনকে খলিফা সম্বোধন করতে শুরু করে। আজ পর্যন্ত আমাদের গৌরবদীপ্ত পরিচয় আমরা বঙ্গবন্ধুর চার খলিফা। অনেক বিলম্বে হলেও বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় স্বীকৃত জাতির জনক। এবারের ২৩ মার্চে সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে আমার উদাত্ত আহ্বান, একে কটাক্ষ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের কাছেও আমার দাবি— কোনো অবস্থাতেই জাতির জনককে দলীয়ভাবে ব্যবহার করে কোনোরকম বিতর্কিত অবস্থানে তাঁকে নিয়ে না যাওয়ার। ক্ষমতাসীনদের উচিত হবে ভারতের মহাত্মা গান্ধীর মতো তাঁকে দলমতের ঊর্ধ্বে রাখার। নির্বাচনী পোস্টারে জাতির জনকের ছবি ব্যবহার আইনত নিষিদ্ধ করা হোক।

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। এ দিবসে উল্লাস প্রকাশ করা, একটা বিতর্কিত জন্মদিন বানিয়ে জন্মদিনের কেক কাটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সংসদে আইন প্রণয়নের সময় এসেছে বলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রায় সবাই উপলব্ধি করেন।

২৩ মার্চকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সব নেতৃত্বের কাছে আমার আকুতি, আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতের যত পার্থক্যই থাকুক না কেন, ছাত্রলীগের গৌরব মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র, ছাত্রলীগকে অবক্ষয়ের অতলান্তে নিক্ষেপ করার অপপ্রয়াসকে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে যে যার আঙ্গিক থেকে সক্রিয় হয়ে উঠুন। এবারের ২৩ মার্চে পরম করুণাময় আল্লাহর কাছেও আমার একই ফরিয়াদ। ছাত্রলীগ আপন ঐতিহ্যে ফিরে এলে দুর্নীতি, দুর্বিচার ও সবরকমের অবক্ষয় থেকে জাতি রক্ষা পাবে, ইনশাল্লাহ।

বিশ্বজুড়ে যখন সমাজতন্ত্রের উন্মাদনা অগ্নিঝরা সশস্ত্র বিপ্লবের মানসিকতায় উদ্দীপ্ত তরুণ সমাজ, বাংলাদেশেও তখন তরুণ ও যুব সমাজের মধ্যে এ মানসিকতার প্রভাব তুঙ্গে। তার মধ্য থেকে ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সফলতা ও গৌরবময় অর্জন।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর