শুক্রবার, ২৪ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ক্ষুদ্র হালকা শিল্পে বিপ্লব

সাঈদুর রহমান রিমন

ক্ষুদ্র হালকা শিল্পে বিপ্লব

সারা দেশেই আড়ালে-আবডালে ঘটে চলেছে এক অভাবনীয় বিপ্লব। দেশীয় প্রযুক্তির ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন, উৎপাদন ও বাজারজাতে বদলে গেছে দৃশ্যপট। এই কদিন আগেও অতি প্রয়োজনীয় যেসব যন্ত্রপাতি ও মেশিনারিজ শতভাগ আমদানিনির্ভর ছিল, আজ দেশের চাহিদা মিটিয়ে সেগুলো রীতিমতো রপ্তানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রস্তুত মেশিনারিজ এখন চীন-ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্ববাজারে ঠাঁই করে নিচ্ছে।

ব্যক্তিপর্যায়ের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের নিজ প্রচেষ্টায় অভাবনীয় এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য মহলের সহায়তা আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হালকা ও মাঝারি শিল্পের সফলতায় নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত গড়ে ওঠার সমূহসম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

ক্ষুদ্র ও হালকা শিল্পে ব্যতিক্রমী সাফল্যের মাধ্যমে কয়েক যুগ ধরেই দৃষ্টান্ত হয়ে আছে জিনজিরা। এখানকার ঝুপড়ি বস্তির অজস্র কারখানায় খুদে ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি করা হাজারো পণ্যের কদর রয়েছে সর্বত্র। দেশ-বিদেশে ‘মেড ইন জিনজিরা’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতিও আছে এসব পণ্যের। রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষা জিনিজরা-শুভাঢ্যা থেকে শুরু করে কেরানীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়েই জিনজিরা শিল্পের অভাবনীয় বিস্তার। অনর্গল ইঞ্জিনের ঢস ঢস, ঘট ঘট শব্দ, কারিগরের সদাব্যস্ত হাঁকাহাঁকি, শ্রমিকদের কোলাহল-আওয়াজ ঘুচিয়ে দিয়েছে সেখানকার রাত-দিনের ব্যবধান।

বিস্তার ঘটছে জিনজিরা শিল্পের : শিল্প-কারখানার মালিকরা জানান, গত দুই দশকে ‘জিনজিরা শিল্প’ অগ্রসর হয়েছে অনেক দূর। এখন আর তা জিনজিরা-কেরানীগঞ্জে সীমাবদ্ধ নেই, সম্প্রসারিত হয়েছে রাজধানীর আনাচে কানাচে, দেশজুড়ে। রাজধানীর মীরহাজিরবাগ, মাতুয়াইল, ডেমরা, চকবাজার, লালবাগ, ইসলামবাগ ও মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে জিনজিরা শিল্পের আদলে অসংখ্য ক্ষুদ্র কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। শুধু ঢাকায় নয়, জিনজিরা মডেল অনুসরণ করে নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, চট্টগ্রাম, যশোরের নওয়াপাড়া, টঙ্গী-গাজীপুর, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ইউনিট।

ধোলাইখাল ব্র্যান্ড সম্ভাবনার খাত : ইঞ্জিন-যন্ত্রাংশ, গাড়ির ক্ষুদ্র পার্টসসহ প্রায় ২০০ ধরনের মেশিনারিজ উৎপাদন ও বাজারজাতের বিশাল সম্ভাবনার খাত হয়ে উঠেছে ‘ধোলাইখাল ব্র্যান্ড’। এ শিল্পের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত পাঁচ লক্ষাধিক লোকের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে এখান থেকে। ধোলাইখাল ব্র্যান্ডের কারিগররা বাইসাইকেল থেকে শুরু করে সব ধরনের গাড়ি, ট্রাক্টর, ক্রেন, রিরোলিং মিল, এমনকি ট্রেনের বগিসহ যাবতীয় যন্ত্রাংশ অনায়াসে প্রস্তুত করছেন। বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহাবুবুল আলম বলেন, দেশের এ হালকা প্রকৌশল শিল্পে প্রায় ৩ হাজার ৮০০ ধরনের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে, যার মধ্যে ১৩৭টি আইটেম রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৭টি দেশে। পুরান ঢাকার মৈশুন্ডি, নবাবপুর, টিপু সুলতান রোড, বনগ্রাম, ওয়ারী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় এ শিল্পের বিস্তৃতি ঘটেছে। ধোলাইখাল ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় অর্ধলক্ষাধিক ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ বা হালকা প্রকৌশল শিল্পের নানা স্থাপনা।

কৃষি যন্ত্রাংশে নীরব বিপ্লব : উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র বগুড়ায় কৃষি যন্ত্রাংশ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ঘটে গেছে নীরব বিপ্লব। বিসিক শিল্পনগরীসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির সাত শতাধিক কল-কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি যন্ত্রাংশের মধ্যে রয়েছে পানির পাম্প, টিউবওয়েল, শ্যালো ইঞ্জিনের লাইনার, পিস্টন, পাওয়ার টিলার, ধান ও ভুট্টা মাড়াই মেশিনসহ সব কৃষি উপকরণ। এ ছাড়া প্ল্যানার, ক্রাঙ্ক শ্যাফট গ্রানডিং, মিলিং, সেপার, বোরিং মেশিন, লেদ মেশিন, স’ মেশিন ইত্যাদি তৈরি হয়। বগুড়ার বিসিক, গোহাইল রোড, স্টেশন রোড, রেলওয়ে মার্কেট, সান্তাহারসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানাগুলোর উৎপাদিত যন্ত্রাংশ আন্তর্জাতিক বাজারে নিয়ে যেতে হলে দরকার পাম্প টেস্টিং সেন্টার, হিট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, মডেল ওয়ার্কশপ নির্মাণ।

রপ্তানিতেও পিছিয়ে নেই : বাংলাদেশ বাইসাইকেল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও অর্জন করেছে ব্যাপক সফলতা। বাইসাইকেল উৎপাদনে বিশ্বের ১০টি প্রথম সারির উৎপাদকের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করা যায়। ২০১৩-১৪ সালে বাইসাইকেল রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, আধুনিক মানের সাইকেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুঁজি সংকটই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা বা ব্যাংক ঋণ কোনোটাই জুটছে না তাদের ভাগ্যে। কেরানীগঞ্জের তাওয়াপট্টি এলাকার ক্ষুদ্র কারখানার মালিক মোজাম্মেল হক বলেন, সেখানে তৈরি হচ্ছে গিয়ার বক্স, বেলপুনি, পিনিয়ামসহ সম্পূর্ণ লেদ মেশিন, টেক্সটাইল মিলের প্লেট, হুইল, সিমেন্ট কারখানার মিডিয়া বল, স্লিপ, বাস-ট্রাকের গিয়ার বক্স, প্রেশার প্লেট এবং রিকশা-সাইকেলের সব যন্ত্রাংশ। ৩৫-৩৬ লাখ টাকা দামের হোফার মেশিন, ৪০ লাখ টাকার সেফার মেশিন, ৬ থেকে ১৪ ফুটের লেদ মেশিন, ড্রিল ও গ্রেনডিং মেশিনসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি পুরোপুরি দেশি প্রযুক্তিতে এখন প্রায় অর্ধেক দামে প্রস্তুত হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে খুদে কারিগররা সামুদ্রিক জাহাজের অতি মূল্যবান পিনিয়ামও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর