শিরোনাম
শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
হত্যাযজ্ঞ বর্বরতার ২৫ মার্চ ১৯৭১

আজ সেই কালরাত গণহত্যা দিবস

মাহমুদ হাসান

৪৬ বছর পর ২৫ মার্চের সেই কালরাত গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি পেল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিষয়টি জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে এবার প্রথমবারের মতো ২৫ মার্চ পালিত হচ্ছে গণহত্যা দিবস হিসেবে। এ উপলক্ষে মধ্যরাত থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর  বর্বর হত্যাযজ্ঞের দিনটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় গত ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে। এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের প্রস্তাবও অনুমোদন দেওয়া হয়। এদিকে এই দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য জাতিসংঘে যোগাযোগ করছে বাংলাদেশ। ৪৬ বছর আগে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) মুক্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দমন ও জাতিগত শুদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে লাগাতার গণহত্যা শুরু করেছিল ২৫ মার্চ রাতে। পাকিস্তান বাহিনীর আকস্মিক গণহত্যা শুরুর পরিপ্রেক্ষিতে বীর বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করে। সে সময় হানাদার বাহিনীর ওই গণহত্যার খবর ও সচিত্র প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। গত শতকে বিশ্বের ভয়াবহ গণহত্যাগুলোর অন্যতম ছিল বাংলাদেশের এই গণহত্যা। একরাতে কেবল ঢাকা শহরে অর্ধ লক্ষাধিক নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তান বাহিনী। গণহত্যা দিবস ঘোষণার ফলে আগামী প্রজন্ম ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের মতো মর্মান্তিক ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিতি হওয়ার সুযোগ পেল। তারা জানবে, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য পূর্ব পুরুষরা কিভাবে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতা ও গণহত্যার চিহ্ন নেই। সেই গণহত্যার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর পাশাপাশি আলবদর, আলশামস, রাজাকাররা সমান দায়ী। ইতিমধ্যে সরকার ঘোষণা করেছে, বাংলাদেশ দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে এর প্রেক্ষাপট ও তাত্পর্য তুলে ধরে বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক তত্পরতা চালাবে। কেননা জাতিসংঘে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালিত হয়ে আসছে। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন গৃহীত হয়েছিল। এ কারণে ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয় ২০১৫ সালে। মাতৃভাষার জন্য বাঙালির আত্মোৎসর্গকে স্মরণ করে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তেমনি একরাতে একটি শহরে ৫০ হাজারের বেশি নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার স্মরণে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ৯ ডিসেম্বর নয়, ২৫ মার্চ হওয়া উচিত। এদিকে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের মাধ্যমে জাতীয় জীবনের এক নতুন ঐতিহাসিক অধ্যায় এবং মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের আত্মার প্রতি জাতীয় দায়বদ্ধতা পূরণ করা হবে। উল্লেখ্য, চার দশকের বেশি সময় ধরে অনেক শহীদ পরিবার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী সংগঠন ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিল। ১৯৯৩ সালে শহীদজননী জাহানারা ইমাম ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলেন। তখন থেকেই একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি এ দাবি জানিয়ে আসছিল। আজকের প্রজন্ম জানে না ৪৬ বছর আগে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কি ঘটেছিল এই বাংলায়। ২৫ মার্চ দিবাগত সেই কালরাতে বাংলার বুকে নেমে এসেছিল মৃত্যুর ঘনতমসা। রাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাশব শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঢাকার নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর। মেশিনগান, মর্টার ও ট্যাংক নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ৫০ হাজারের বেশি ঘুমন্ত নাগরিককে। ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। রাতে পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস, শিক্ষক কোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) ব্যারাকসহ ঢাকার আবাসিক এলাকা এবং বস্তিবাসীর ওপর বর্বর আক্রমণ চালিয়ে সূচনা করে ৯ মাসব্যাপী ইতিহাসের নজিরবিহীন গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ। শস্য-শ্যামল বাংলাদেশকে অগ্নিবলয়ে নিক্ষেপের মাধ্যমে শুরু হয় মানবতার বহ্ন্যুৎসব। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অভিযান শুরুর জন্য রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। ফার্মগেটের মুখে হানাদারবাহিনী প্রথম প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। এখানে তারা লাউডস্পিকারে গোটা ঢাকায় কারফিউ জারির ঘোষণা দেয়। ছাত্র-জনতা সেনাবাহিনীকে বাধা দিলে তারা মেশিনগানের সাহায্যে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। ডিনামাইট দিয়ে ব্যারিকেড উড়িয়ে দিয়ে শহরে প্রবেশ করে। রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় খণ্ডযুদ্ধ। চারদিকে গুলি আর গোলার বিস্ফোরণ। মানুষের আর্তচিৎকার। পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র বাঙালির বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করলে সেই ভয়াল রাতে ঠিক ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তান শাসনের ম্যান্ডেড লাভকারী পূর্ব পাকিস্তানের নেতা ও বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবন থেকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। রাত ১২টার পর বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে এ ঘোষণা বেতারে একবার শোনা যায়। পিলখানা ইপিআর (বিজিবি) ব্যারাক থেকেও স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে বার্তা আকারে পাঠানো হয়। পাকিস্তান সেনারা রাত দেড়টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের ভিতরে প্রবেশ করে তাকে বন্দী করে নিয়ে যায়। মধ্যরাতেই সেনাবাহিনী পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেতে ইকবাল হল (জহুরুল হক), ঢাকা হল (শহীদুল্লাহ), জগন্নাথ হলসহ বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও শিক্ষক কোয়ার্টারে আক্রমণ করে। সেনারা পিলখানা ও নীলক্ষেতে প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। রাত ২টার সময় হানাদারবাহিনী ট্যাংক, বাজুকা, মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কৃতী অধ্যাপকসহ বিপুলসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীকে হত্যা করে। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর পিলখানা ব্যারাকের পতন হয়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন হামলাকারীদের কব্জায় আসে রাত ২টায়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাংক-মর্টারের গোলায়, আগুনের লেলিহান শিখা একদিকে নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়, অপরদিকে এ রাতের ওপর উপ্ত হয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। পরের দিন নবসূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় নতুন প্রতিজ্ঞার ইতিহাস, শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ, জনযুদ্ধ। এবার প্রথম গণহত্যা দিবস পালন উপলক্ষে ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। সেই ভয়াল রাতের স্মরণে আজ শহীদদের স্মরণে বিভিন্ন স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তন প্রাঙ্গণে জমায়েত এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হবে। এ ছাড়া আজ সকাল সাড়ে ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ সংলগ্ন স্থানে ‘রক্তাক্ত ২৫ মার্চ : গণহত্যা ইতিবৃত্ত’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী, আলোচনা সভা, গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গীতিনাট্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভা, গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর