শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে ভয়াল রাত

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে ভয়াল রাত

‘রাত ১০টার পরে সারা শহরে কারেন্ট চইল্যা গেল। অন্ধকারে কুপি জ্বালায়্যা রাতের খাবার খাইলাম। এরপর চারদিকের অবস্থা বোঝার জন্য হাঁটতে হাঁটতে গেটের দিকে গ্যালাম। রাত প্রায় ১১টার কাছাকাছি গেট দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে ঢুকে এক লোক আমাকে বলল, ‘৩৭টি ট্রাকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়্যা মেলেটারি আসতেছে। ওরা কাকরাইল পাড় হয়েছে। আপনিই বোঝেন তাইলে আর কতক্ষণ লাগবে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আসতে। আপনারা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।’ আমি বললাম আপনাকে যে বিশ্বাস করব আপনি কে? ‘সে বলল আমি শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে।’ অন্ধকারে আমি তার মুখ পরিষ্কারভাবে দেখতে পাইনি। সে সময় আমি ভাবলাম শেখ মুজিব খবর পাঠাইছে এটা পালন করা আমার দায়িত্ব। তখন আমি দিলাম এক দৌড় ম্যাগজিন গার্ডের রুমের দিকে। আর সবাইকে জাগানোর জন্য চিৎকার দিলাম ম্যাগজিন গার্ড, হাবিলদার মেলেটারি আইছে। চিল্লাইতে চিল্লাইতে আল্লাহর নামে পাগলা ঘণ্টায় দিলাম বাড়ি। আর চিন্তা করলাম আল্লাহ ঘণ্টায় বাড়ি দিয়্যা যুদ্ধতো লাগাইল্যাম এখন বাঁচা-মরা তোমার হাতে। চিৎকার আর ঘণ্টার বাড়িতে ততক্ষণে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সব পুলিশ এক জায়গায় জড়ো হয়ে গেছে।’ এক নিঃশ্বাসে ২৫ মার্চের কালরাতের সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে হাঁপাচ্ছিলেন তৎকালীন আইজিপির বডিগার্ড আবদুল আলী খান। এরপর সার্জেন্ট মর্তুজা অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে উপস্থিত বাঙালি সৈনিকদের অস্ত্র নিতে বলেন। সবাই অস্ত্র গুলি হাতে নিয়ে চতুর্দিকে ডিফেন্সে বসে যায়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে চামেলীবাগ, ফকিরাপুল এবং মালিবাগ তিন দিক থেকে ফায়ারিং শুরু করে মিলিটারিরা। আর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাঙালি পুলিশরা থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে বুক চিতিয়ে পাকিস্তানিদের ভারী অস্ত্রের সামনে গড়ে তোলে প্রথম প্রতিরোধ। আবদুল আলী খান জাগিয়েছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে আর তৎকালীন ওয়্যারলেস অপারেটর শাহজাহান মিয়া জাগিয়েছিলেন পুরো দেশকে। কথা শুরু করতেই হঠাৎ তার মোবাইলে বেজে ওঠে ‘যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা।’ আর সে মাটির টানেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের হেলিকপ্টার ব্র্যান্ডের ওয়্যারলেস থেকে দেশের অন্যান্য থানা এবং পুলিশ লাইনে জানিয়েছিলেন পাক আর্মিদের আক্রমণের খবর। নিজেই ইংরেজিতে লিখেছিলেন, ‘বেইজ ফর অল স্টেশন্স অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ। প্লিজ কিপ নোট। কিপ লিসেনিং ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলভস, ওভার।’ এরপর শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। ‘রাত সোয়া ১১টার দিকে পাকিস্তানি আর্মিরা শান্তিনগর মোড় পার হওয়ার চেষ্টা করে। ওখানে ব্যারিকেড থাকায় ওরা প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তখনই গুলি ছুড়ি আমরা। টানা দুই ঘণ্টা আমাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেলের সঙ্গে ওদের আধুনিক অস্ত্রের যুদ্ধ চলে। তখন এগুতে না পেরে থেমে যায় ওরা। রাত আড়াইটার দিকে সার্চ লাইট ফেলে শুরু করে মেশিন গান আর ট্যাঙ্ক দিয়ে গোলাবর্ষণ। আস্তে আস্তে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে এগিয়ে আসে ওরা। একসময় পুলিশ লাইনের কোনার টিনের চালা দেওয়া স্টোররুমগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয় ওরা। আগুনের ফুলকির সঙ্গে টিন উড়ে আসতে থাকে আমাদের দিকে। আস্তে আস্তে পেছাতে থাকি আমরা। একসময় আজান হয়, ভোরের আলো ফোটে। আমি আর দুজন গিয়ে আশ্রয় নিই পানির ট্যাঙ্কির নিচে। ওরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওখান থেকে আমাদের বের করে নিয়ে আসে। এরপর ২৮ মার্চ পর্যন্ত আমাদের ওপর চালায় অবর্ণনীয় নির্যাতন। ওই দিন বিকালে ছাড়া পেয়ে বাড়ি যাই এবং ছোট দুই ভাইকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেই। আমার ছোটভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে আর যুদ্ধ করতে গিয়ে মেজ ভাইয়ের মুখের এক পাশ উড়ে গেছে। যাই হোক আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর