শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
আগুনঝরা মার্চ

জয়দেবপুরের পথ ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর

নজরুল ইসলাম খান

জয়দেবপুরের পথ ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গাজীপুরের জয়দেবপুরে তখন আমি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম। ওই সময় সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। তবুও শ্রমিক সংগঠনের নেতা হিসেবে আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত ছিলাম। যখন ১ মার্চ সংসদ অধিবেশন স্থগিত করা হলো তখন সারা দেশের মতোই জয়দেবপুরেও সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকে। সুসংগঠিত শক্তি হিসেবে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ওইদিন সন্ধ্যায় পশু চিকিৎসক আহমেদ ফজলুর রহমানের বাসায় বসে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও শ্রমিক নেতবৃন্দ বসে ‘সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করি। সম্ভবত এটাই দেশের প্রথম সংগ্রাম পরিষদ। এতে তিনজনকে হাইকমান্ড হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তারা হলেন, আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুল্লাহ মাস্টার, ন্যাপ (মোজাফফর) নেতা মনিন্দ্র গোস্বামী ও শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এম এ মোত্তালিব।  এখনকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে আহ্বায়ক ও আমাকে কোষাধ্যক্ষ করে ১১ সদস্যের সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। পরে এই সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে জয়দেবপুরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হয়। অবশ্য ওই সময় জয়দেবপুরে জাসদের আবদুস সাত্তার, শ্রমিক নেতা শেখ মোহাম্মদ আবুল হোসেন, সাবেক ছাত্রনেতা শহিদুল্লাহ বাচ্চু, সাবেক ছাত্রনেতা হারুন অর রশীদ ভূঁইয়া ও জিন্নাহসহ অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বেই ৫ মার্চ সিদ্ধান্ত নেই, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে বাঙালিদের তৈরি অস্ত্র দিয়ে বাঙালিদের মারা যাবে না। অস্ত্র উৎপাদন বন্ধের জন্য আমরা মিছিল নিয়ে কম্পাউন্ডে ঢুকি। তখন সমরাস্ত্র কারখানার দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাহ নামে এক পাকিস্তানি। তিনি সেখানে সেনাবাহিনী নিয়ে আমাদের বাধা সৃষ্টি করেন। এক পর্যায়ে তারা হাঁটু গেড়ে বসে অস্ত্র তাক করে সশস্ত্র অবস্থান নেয়। এরমধ্যেই আমরা দেখি দক্ষিণ দিক থেকে কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হয়ে আসছে। তাদের নিয়ে আমরা ফিরে আসি। বস্তুত সংগ্রাম কমিটি নিয়ে আশপাশের এলাকায় সফর ও সভা-সমাবেশ করি। স্বাধীনতার পক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য দিতে থাকি। ঢাকায় যেসব আন্দোলন কর্মসূচি হতো তা আমরা পালন করতে থাকি।

১৯ মার্চ আমরা খবর পাই গাজীপুর সেনানিবাসে (অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট) ঢাকা সেনানিবাস থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসবেন এবং বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করবেন। সিদ্ধান্ত নেই, তাদের আমরা গাজীপুর সেনানিবাসে ঢুকতে দেব না। সেজন্য আমরা টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর সর্বত্রই প্রতিরোধ সৃষ্টি করি। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, প্রতিপক্ষের আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিলে সবাই যোগাযোগ করবে। কারখানায় বলা ছিল, সাইরেন বাজানো হবে। এটা শুনেই সবাইকে মেইন গেটে আসতে হবে। ১৯ মার্চ খবর পেলাম, পাকিস্তান আর্মিরা আসছে। তখন সাইরেন বাজানো হয়। সবাই মূল গেটে একত্র হই। সেদিন ছিল জয়দেবপুরে হাট। মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে দৌড়ে মিছিল করে কয়েকশ শ্রমিক চলে আসি জয়দেবপুর বাজারে। পাকিস্তানবিরোধী স্লোগানে মিছিলে প্রকম্পিত হয় ওই হাট। এরপর পাকিস্তানি আর্মিরা চুপচাপ গাজীপুর সেনানিবাসে চলে যায়।

কয়েকজন সেনা একজন জেসিওসহ একটি পিকআপে করে আসছিল। তাদের জনতা ধাওয়া করে সব অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। কারখানার সিকিউরিটি গার্ড, এলাকার মানুষের বন্দুক ছিল, যাদের কিছুই নাই তারা সুরকি বল্লম ও পাথর নিয়ে অবস্থান নেয়। এরপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে পাকিস্তানি সৈন্যরা। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আব্রারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাস থেকে আমাদের দিকে তেড়ে আসে। এরমধ্যে আমরা রাজবাড়ী থেকে জয়দেবপুর বাজার হয়ে চৌরাস্তা হয়ে ঢাকার পথে রাস্তায় রেল লাইনের ওপরে মালগাড়ির বগি টেনে রাস্তার ওপরে রেখে দেই। দুইপাশের স্লিপার তুলে ফেলি। যাতে বগি সরানো না যায়। রাস্তা বন্ধ করে দেই। পূর্বদিক থেকে পাকিস্তানি সেনারা আসছে। কিছু বাঙালি সেনাদের বাধ্য করে তাদের সঙ্গে নিয়ে আসছে। তারা মাইকে সবাইকে সরে যেতে বলেন। না হলে গুলি চালানোর হুমকি দেয়। কিন্তু জনগণ কিছুই শুনছিলেন না। যার যা আছে তাই সেনাদের উদ্দেশ্যে মারতে থাকে।

আজিম উদ্দিন মাস্টার নামে এক বৃদ্ধও নিজস্ব বন্দুক নিয়ে আসেন। লুট করা অস্ত্র দিয়েও তাদের মোকাবিলা করতে থাকি। তারা লাল পতাকা নিয়ে যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিয়ে আসে। এই সময় হঠাৎ টঙ্গীর সাবেক এমপি শামসুল হক আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। ঢাকার খবরাখবর শুনছিলাম। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথাবার্তা আমি এক্সচেঞ্জে শুনছিলাম। এ সময় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পাকিস্তানি আর্মিরা বাঙালি সেনাদের ধরে নিয়ে আসছে। তাদের কমান্ডার লে. কর্নেল মাসুদুল হাসান খান। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর সফিউল্লাহ, ক্যাপ্টেন মইনুল হোসেন চৌধুরী (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা) ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান চৌধুরী, লে. ইবরাহিমসহ (কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান) কয়েকজন সেনা অফিসার ছিলেন। তাদের যখন বাঙালিদের ওপর গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়, তারা উপরের দিকে গুলি করছিলেন। এটা দেখে তাদের সরিয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের গুলি করতে বলা হয়। এ সময় আমাদের কয়েকজন নিহত হন। আমাদের গুলিতেও তাদের কয়েকজন মারা যায়। এ সময় তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। তারা কারফিউ ঘোষণা দিয়ে বললেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চলে যেতে। নইলে সবাইকে গুলি করা হবে। গোলাগুলির সময় আমি টেলিফোনে সেই আওয়াজ শামসুল হককে শোনাচ্ছিলাম। তিনি তা শেখ মুজিবকেও শোনাচ্ছিলেন। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের লোকেরা সেই বগি সরিয়ে নেয়। চৌরাস্তায় তারা প্রতিরোধের মধ্যে পড়ে। সেখানেও আমাদের কয়েকজন শহীদ হন। মূলত প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ হয় গাজীপুরে। সেদিন থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশেই স্লোগান হতে থাকে, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। এটা সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ প্রথম স্লোগান দেয়। এর আগে কোথাও এ ধরনের স্লোগান দেওয়া হয়েছে কি না জানি না। সারা দেশে নিরস্ত্র প্রতিরোধ ছিল।

২০ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল করা হয়। জেনারেল সফিউল্লাহসহ আমাদের অনুরোধে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো ফেরত দেওয়া হয়। নইলে বাঙালি সেনাদের কোর্ট মার্শাল করে হত্যা করা হতো। যশোর থেকেও ২৫ মার্চের রাতের হামলায় জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাঙালি সেনাদের আমরা সরিয়ে নিতে সহায়তা করি। তারা যাওয়ার পরেও সেনানিবাস থেকে বেশকিছু অস্ত্র আমরা লুট করি। ২৭ মার্চ বিকালে জয়দেবপুর রাজবাড়ীসহ আশপাশে যখন বোমা ফেলানো হয়, তখন আমরা জয়দেবপুর ত্যাগ করতে বাধ্য হই। আমি তখন কাপাসিয়া হয়ে নৌকা করে ধলা যাই। সেখান থেকে ট্রেনে করে ময়মনসিংহ হয়ে জামালপুর চলে যাই। ওইসময় পাকিস্তানি আর্মিরা পুরো ক্যান্টনমেন্ট দখলে নেয়। আমি পরবর্তীতে মহেন্দ্রগঞ্জে ১১ নম্বর সেক্টর প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখি। পরবর্তী পর্যায়ে তিন নম্বর সেক্টরে যুদ্ধে কাজ করি। দুর্ভাগ্য হলো, এখন তো আমাদের কেউ মুক্তিযোদ্ধা বলে না। এখন মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে মুক্তিযোদ্ধার চেতনার ফেরিওয়ালাদের গুরুত্ব বেশি। এটা জাতিরও দুর্ভাগ্য।

লেখক : স্থায়ী কমিটির সদস্য—বিএনপি

অনুলেখক : মাহমুদ আজহার

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর