শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

তিন শিশুসহ পরিবারের পাঁচজনেরই মৃত্যু

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১০

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

তিন শিশুসহ পরিবারের পাঁচজনেরই মৃত্যু

দুর্ঘটনায় উল্টে গেছে ট্রাক —বাংলাদেশ প্রতিদিন

ভোরের আলো ফোটার আগেই ময়মনসিংহের ভালুকায় ঝরে গেছে নারী-শিশুসহ ১০ জনের প্রাণ। এর মধ্যে একই পরিবারের পাঁচজন রয়েছেন। সিমেন্ট বোঝাই একটি ট্রাক গর্তে পড়ে উল্টে গেলে এ ঘটনা ঘটে। সিমেন্টের বস্তার ওপর বসে এসব নারী-শিশু বাড়ি ফিরছিল। গতকাল ভোররাত পৌনে ৪টার দিকে মেহেরবাড়ি এলাকায় এ মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে।

জানা গেছে, ট্রাক উল্টে যাওয়ার পর ট্রাক ও বস্তার নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান একই পরিবারের পাঁচজন ও আরেক পরিবারের দুজন। এ ছাড়া অন্য আরও তিনজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩ শিশু, ৩ নারী ও ৪ জন পুরুষ রয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪ জন। তাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নিহতদের মধ্যে আছেন একই পরিবারের আজিজুল ইসলাম (৪০), তার স্ত্রী রেজিয়া বেগম (৩২), সন্তান মেহেদি হাসান (১১), নয়ন (৯) ও সিনান (৩)। তাদের বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দায়। আরেক পরিবারের রয়েছেন মা জোসনা বেগম (৫৫) ও ছেলে সিরাজুল ইসলাম (১৯)। এ ছাড়া নিহত হয়েছেন শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সামস উদ্দিনের ছেলে সাজাহান হোসেন (৪০), জঙ্গলদি এলাকার খোরশেদ আলম (২৫), নকলার শুক্কুর আলী (৬৫)। ভালুকা মডেল থানার ওসি মামুনুর রশিদ জানিয়েছেন, জামালপুরগামী একটি সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক উপজেলার মেহেরবাড়ী এলাকায় সড়কের গর্তে পড়ে উল্টে যায়। এ সময় সিমেন্টের নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই ৯ জন মারা যান। পরে ভালুকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরও একজন মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শী হানিফ খান বলেন, ভোর পৌনে ৪টার দিকে বিকট শব্দ শুনতে পাই। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি দশ জনের বেশি যাত্রী সিমেন্টের বস্তার নিচে চাপা পড়ে আর্তনাদ করছে। পুলিশ এবং স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলে ফায়ার সার্ভিস এসে লাশ উদ্ধার করে। স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যার ইন্সপেক্টর রেজাউল করিম বলেন, লাশ উদ্ধার করতে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট কাজ করেছে। ৯টি লাশ উদ্ধার করে ভালুকা মডেল থানায় স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে খবর পাওয়ার পরপরই ভালুকা মডেল থানায় নিহতদের মরদেহ নিতে আসেন স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। পরিবারের কেউ কেউ এ সময় বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বাকিরা মৃতদেহের পাশে বসে বিলাপ করছিলেন। একই পরিবারের পাঁচজন নিহতের মধ্যে রয়েছেন রেজিয়া। তার ভাই জাহিদুল ইসলাম জানান, বেশ কিছু দিন ধরে পুরো পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস করছে রেজিয়া। পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আহতদের সঙ্গে কথা বলে আমরা চেষ্টা করছি ট্রাকচালক এবং হেল্পারকে খুঁজে বের করতে। তারা পলাতক রয়েছেন। ট্রাকের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ট্রাকটি শেরপুর রাইস মিলের এক ব্যক্তির।

তদন্ত কমিটি : এ ঘটনায় ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আরিফ আহমেদ খানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সরকারি সহায়তা দেওয়া হবে। নিহতদের দাফনের ব্যবস্থা করতে নিজ নিজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পাঁচ পরিবারের গ্রামে মাতম : শোকের সাগরে ভাসছে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার রাকিরকান্দা গ্রাম। নিহত স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে গোটা এলাকা। গতকাল বিকালে সরেজমিনে দেখা গেছে, সান্ত্বনা দিতে এসেও অনেকেই ঝরাচ্ছিলেন চোখের জল। তিন দিনের ছুটি কাটাতে যে আনন্দ নিয়ে আসছিলেন আজিজুল ইসলাম ও তার পরিবার, তা ম্লান করে দিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। এখন মৃত্যুশোক জেঁকে বসেছে গ্রামটিতে। শোক সইতে না পেরে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন আজিজুলের ছোট দুই ভাই নজরুল ইসলাম ও শামসুল ইসলাম। আর তাদের মায়ের কপালে ছেলের লাশ শেষবারের মতো দেখার সৌভাগ্যটুকুও হয়নি। তিনি ঢাকার একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন বলে জানা গেছে। ছেলে, ছেলেবউ ও নাতি-নাতনিদের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি ছুটে এলেও ততক্ষণে তাদের শোয়ানো হয় মাটির শীতল বিছানায়। আজিজুলের ছোট ভাই বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘এই ভাই আমাদের সুখ-দুঃখ দেখত, আমাদের চালাইত। অহন দেখব কেডা?’ গ্রামের বাড়িতে দেখা যায়, ছন-চটকির বেড়া দিয়ে দুটি ঘর বানানো। যেখানে তিন ভাই ও তাদের পরিবার মিলেমি থাকতন।

সর্বশেষ খবর