রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

রক্তাক্ত সিলেট পুলিশসহ নিহত ৪

বোমা বিস্ফোরণে র‌্যাবসহ আহত ৪৩, জঙ্গি আস্তানায় সেনা অভিযান, ব্যাপক গোলাগুলি

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

রক্তাক্ত সিলেট পুলিশসহ নিহত ৪

সিলেটে গতকাল বিস্ফোরণে আহত কয়েকজন। জঙ্গি আস্তানায় অপারেশন টোয়াইলাইটে সেনা কমান্ডোরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় আধঘণ্টার ব্যবধানে জঙ্গিদের দুই দফা বোমা হামলায় পুলিশের এক কর্মকর্তাসহ চারজন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজনকে আত্মঘাতী বলে ধারণা করছে পুলিশ। এ ছাড়া পুলিশের এক পরিদর্শক, ওসি ও এক র‌্যাব কর্মকর্তাসহ আহত হয়েছেন অন্তত ৪৩ জন। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা ও ৭টায় যথাক্রমে সেনাবাহিনীর ব্রিফিং স্থলের কাছে ও পূর্ব পাঠানতলা মসজিদ এলাকার মাদ্রাসার সামনে বোমার  বিস্ফোরণ ঘটে। এর প্রায় আড়াই শ গজ দূরে শিববাড়ীর আতিয়া মহল নামক ভবনে অবস্থান করছে জঙ্গি সদস্যরা। তাদের আটক করতে গতকাল দিনভর সেখানে অভিযান চালিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো সদস্যরা। তবে ভবনটিতে আটকা পড়া ৭৮ জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন তারা। নিহত পুলিশ কর্মকর্তা হলেন সিলেট মহানগর পুলিশের পরিদর্শক আবু কাওসার। তার বাড়ি সুনামগঞ্জ। তিনি শহরের জামাইপাড়া এলাকার মৃত আছদ্দর আলী চৌধূরীর ছেলে। সাত ভাই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। অন্য নিহতরা হলেন নগরীর দক্ষিণ সুরমার চাঁদনীঘাটের সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আওলাদ হোসেনের ছেলে ও ছাত্রলীগ কর্মী ওয়াহিদুল ইসলাম অপু (২৬) এবং দাড়িয়াপাড়ার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম (২৮)। অপু মদনমোহন কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বলে জানিয়েছেন তার বন্ধু জয়শর্মা চৌধুরী। বন্ধুর ভাষ্য, দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে ওয়াহিদুল সবার বড়। অন্য নিহত ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়নি। দুই দফা বিস্ফোরণে তিনজন নিহতের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার জেদান আল মূসা। আহতদের মধ্যে রয়েছেন মহানগর পুলিশের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম, দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি হারুনুর রশীদ, র‌্যাব কর্মকর্তা আবুল কালাম ও স্থানীয় দৈনিক ‘সিলেটের মানচিত্র’-এর আলোকচিত্রী আজমল আলী। আহতদের মধ্যে পুলিশসহ অন্তত ৪০ জন সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এর মধ্যে শিরিন মিয়া, জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম ও দক্ষিণ সুরমা থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জনি লাল দের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গুরুতর আহতদের মধ্যে র?্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদসহ আরেক সহযোগীকে রাত সাড়ে ১০টার দিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় পাঠানো হয়। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, এই মোটরসাইকেল ব্যবহার করে বোমা হামলাটি চালানো হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে আতিয়া মহলে অভিযান নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে সেনাবাহিনী। আধঘণ্টার মধ্যে শেষ হয় ব্রিফিং। ব্রিফিং শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট পর পার্শ্ববর্তী গোটাটিকর দাখিল মাদ্রাসার সামনের রাস্তায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই দুজন নিহত হন। আহত হন আরও অন্তত ১৫ জন। নিহতদের একজন আত্মঘাতী হতে পারে এমন ধারণার কথা জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার জেদান আল মূসা। তিনি আরও জানান, বিস্ফোরণের খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান পরিদর্শক আবু কাওসার, পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম ও দক্ষিণ সুরমার ওসি হারুনুর রশীদসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি দল। এ সময় ওই স্থানে অবিস্ফোরিত একটি বোমার বিস্ফোরণে মারা যান পরিদর্শক আবু কাওসার। গুরুতর আহত হন পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম, ওসি হারুনুর রশীদ ও র‌্যাব কর্মকর্তা আবুল কালাম। এদের মধ্যে মনিরুল ও আবুল কালামের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছাড়া ওই বিস্ফোরণে আরও অন্তত পাঁচজন আহত হন। এর আগে আতিয়া ভবনে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলাকালে ভবনের পেছনের মন্দির এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন শিবলু মালাকার নামের স্থানীয় এক যুবক। ধারণা করা হচ্ছে, পাঁচ তলা ভবনটি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে একটি মোটরসাইকেলে করে দুই যুবক ব্রিফিংস্থলের কাছাকাছি পৌঁছান। তখন বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে দুই যুবক ছিটকে পড়েন। এরপর আরেকটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। যুবকদের সঙ্গে রাখা ব্যাগে বোমা ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে, দুই দফায় পুলিশসহ চারজন নিহত হওয়ার পর এবং একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনায় সিলেটজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। বোমা বিস্ফোরণে চারজন নিহত হওয়ার আগে আতিয়া মহল ঘিরে ছিল সাধারণ মানুষের ভিড়। তবে এ ঘটনার পরই আতিয়া মহলের চারপাশ একেবারেই ফাঁকা হয়ে যায়। এ ছাড়া পুরো নগরীও দ্রুত ফাঁকা হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে ঘরে ফেরে নগরবাসী। এ ঘটনার পর নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আতিয়া মহলের আশপাশে কঠোর সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোরা। এ ছাড়া সোয়াত, পুলিশ, র‌্যাব, এসবি, পিবিআইসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও আছেন সতর্কাবস্থানে। বোমা হামলার ঘটনাস্থল গোটাটিকর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা এলাকায় সার্চলাইট লাগানো হয়েছে। এ এলাকায় বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। জোরদার করা হয়েছে টহল। তবে পরিস্থিতি এখন থমথমে। উদ্বেগ আর আতঙ্কে রয়েছে এলাকার মানুষ। এদিকে পাঠানপাড়ার আতিয়া মহলে জঙ্গিদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোদের লড়াই চলছে। কমান্ডো ও সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে দফায় দফায় বোমা ও গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে জঙ্গিরা। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ১৭ ব্যক্তি। গতকাল সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত অভিযানে জঙ্গিদের অবস্থান করা পাঁচ তলা ওই ভবনের ২৯টি ফ্ল্যাট থেকে ৭৮ বাসিন্দাকে নিরাপদে উদ্ধার করেছেন কমান্ডোরা। আতিয়া মহল নামের ওই ভবনের নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকা জঙ্গিরা শক্তিশালী ও সংগঠিত বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনীর ব্রিফিং : গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে প্রেস ব্রিফিং করে সেনাবাহিনী। ব্রিফিংয়ে সেনা সদর দফতরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, ‘আতিয়া মহলে অভিযান এখনো চলছে। গত পরশু রাতে পুলিশের কাছে তথ্য আসে, এ ভবনে জঙ্গি আছে। এরপরই ভবনটি কর্ডন করে রাখে পুলিশ। ভিতরে যেসব জঙ্গি আছে, তারা সংগঠিত ও শক্তিশালী। এজন্য পুলিশ সোয়াতের সাহায্য চায়। সোয়াত নিজেদের পদ্ধতিতে অভিযান চালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ভিতরে থাকা জঙ্গিরা শক্তিশালী ও ভবনে অনেক লোক আটকা পড়া অবস্থায় থাকায় তারা অভিযান না করে সেনাবাহিনীকে ডাকে। অভিযানের ডাক পেয়ে শুক্রবার রাতে একটি টিম পর্যবেক্ষণে আসে। গতকাল সকাল ৮টার দিকে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো টিম অভিযান শুরু করে। দুপুর ২টা পর্যন্ত অভিযানে ২৯টি ফ্ল্যাট থেকে ৭৮ জনকে উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন মহিলা ও ২১ জন শিশু ছিল। ভবনে প্রায় দেড় শ রুম ছিল, সেখান থেকে সার্চ করে নিরাপদে তাদের উদ্ধার করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ছিল যাতে ভবনে আটকা পড়া লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়। অভিযানকারী দল সে নির্দেশ সফলতার সঙ্গে পালন করতে সক্ষম হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভবনের ছাদের ঘর থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরক ছড়িয়ে রাখে জঙ্গিরা। এজন্য উদ্ধারের সময় বেশি লাগে। জঙ্গিরা ভিতরে আছে, তবে কজন আছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ পর্যন্ত ১০-১২টি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তারা।’

সর্বশেষ খবর