রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ধারাবাহিক সাফল্যে বাংলাদেশ

জুলকার নাইন

ধারাবাহিক সাফল্যে বাংলাদেশ

দুইশ বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং দুই যুগ ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের পর একাত্তরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময় বাংলাদেশের রাজকোষ ছিল প্রায় শূন্য। ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ভঙ্গুর অবকাঠামো। ফলাফল, স্বাধীনতার পরপরই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি অংশে জেঁকে বসা মঙ্গাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে বাংলাদেশ। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি বিশ্বদরবারে রাষ্ট্র হিসেবে নিজের সক্ষমতার জানান দিয়েছে ধারাবাহিকভাবেই। একে একে সাফল্য দেখিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অনেক দেশেরই রোল মডেল। সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বও এখন বাংলাদেশকে বসিয়েছে মর্যাদার আসনে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি রুশনারা আলীর ভাষায়, ‘ইউরোপের অনেক দেশের কাছেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঈর্ষণীয়। এ কারণেই আড়াইশরও বেশি ব্রিটিশ কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগে বাধ্য হয়েছে।’ অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের ৩০০ রেল সেতু, ৭১ মাইল ট্র্যাক, ১৪০ লোকোমোটিভ, ৩৬৭টি প্যাসেঞ্জার কেরিয়ার ও এক হাজার ৪৮৪টি ওয়াগন ধ্বংস করা হয়। ভেঙে ফেলা হয় সড়ক ও মহাসড়কের ২৭৪টি সেতু ও কালভার্ট। এ ছাড়া ৯৬টি ফেরির মধ্যে ৬৬টি হয় ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে, না হয় ধ্বংস করা হয়েছে। এক হাজার ৯৫২টি বাস, চার হাজার ট্রাক ও ১৬৬টি জাহাজ (ভেসেল) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন অবকাঠমো নিয়ে মাত্র চার হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে ১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্বের ৩৩তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ঘোষিত বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। প্রথম বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪২ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৪৬২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এখন বাংলাদেশের বাজেটের আকার তিন লাখ ৪০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এই বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। আর এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বিশাল অর্থব্যয়ে  মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের কাজও শুরু হচ্ছে। জানা যায়, একাত্তরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল এখনকার অর্ধেকেরও কম। মাত্র সাত কোটি জনসংখ্যারও খাদ্য নিরাপত্তা ছিল না। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছিল ৯৯ লাখ ৩০ হাজার টন। এ দিয়ে মেটেনি প্রয়োজন, তাই জাহাজে করে খাবার আসবে সেই আশায় বসে থাকতে হয়েছিল। আর এখন জনসংখ্যা ১৬ কোটিরও বেশি, তারপরও খাদ্যে চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। বরং আগের তুলনায় কৃষি জমি কমেছে। এর প্রধান কারণ কৃষকের প্রকৃতি নির্ভরশীলতা কমাতে পেরেছে রাষ্ট্র এবং এদেশের বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন নানান জাতের ফসল ও বিভিন্ন ধরনের কৃষি প্রযুক্তি। ফলে সিডর, আইলার মতো ঝড়ের দুর্যোগও ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি বাংলাদেশের ধারাবাহিক সাফল্যে। বরং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ এখন বড় ত্রাণকর্তার ভূমিকা নিতে পারছে। সর্বশেষ নেপালে ২০১৫ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর সবচেয়ে বেশি সহায়তা গেছে যে দেশটি থেকে তা হলো বাংলাদেশ। নিজের উৎপাদিত খাদ্য থেকে শুরু করে ওষুধ দিয়ে পাহাড়কন্যা নেপালের পাশে দাঁড়াতে পেরেছে বাংলাদেশ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যখন বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন তখন এদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র দুই কোটি ডলার। এখন সেই বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয় ফরেন রিজার্ভের দেশগুলোর একটি। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের এখন রিজার্ভের অঙ্ক ৩ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলারও ছাড়িয়েছে। এখন চাইলে ছয় মাস শুধু আমদানি করেও কাটিয়ে দিতে পারে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পরের পাঁচ বছর মাত্র ২.৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি থাকা বাংলাদেশ গত ২০ বছর টানা ছয় শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে। গত অর্থবছরে ৭ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর এবারও ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের পর যে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার, এখন তা এক হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ বাংলাদেশের অর্জন অনেক। জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, শিশু ও মাতৃমৃত্যু কমেছে। বাড়ছে মাথাপিছু আয়। কৃষিতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। চাষযোগ্য জমি কমলেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া গেছে। রপ্তানি-জিডিপি অনুপাত বেড়েছে। তৈরি পোশাকে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। এর সবই হয়েছে ধারাবাহিকভাবেই। তাই রাজনৈতিক অস্থিরতায় সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা না থাকলে বাংলাদেশের আরও অগ্রগতি প্রত্যাশা করা যেতেই পারত।

সর্বশেষ খবর