রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

শহীদ পরিবারের খবর নেয় না কেউ

বঙ্গবন্ধু ২০০০ টাকা দিলেও পরের সরকারগুলো খোঁজ রাখেনি

গোলাম রাব্বানী, শেরপুর থেকে ফিরে

শেরপুরের নালীতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর বিধবাপল্লীর শহীদ পরিবারগুলোর খবর নেয় না কেউই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে তাদের জন্য ২০০০ টাকা করে বরাদ্দ দিলেও পরের সরকারগুলো তাদের খবরই নেয়নি। শহীদ পরিবারের সদস্যরা আক্ষেপ করে বলেছেন— বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য যা করে গেছেন, এরপরে আর কোনো সরকার আমাদের জন্য কিছু করেননি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা এই গ্রামের ছয় জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছেন, আমাদের আশা বাকিদেরও স্বীকৃতি দেবেন এবং শহীদ পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াবেন।  ১৯৭৩ সালে সোহাগপুরের শহীদ পরিবারের সদস্যরা  ‘সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতি’ নামের সমিতি গঠন করেন। ১৯৭৮ সালে সমিতির রেজিস্ট্রেশন পান তারা। তবে এই সমিতি করেও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তেমন সাড়া মেলেনি। কয়েক বার সামান্য কিছু অর্থ অনুদান পাওয়া গেলেও সমিতির অডিট করাতে তার চেয়ে বেশি খরচ হয়ে গেছে তাদের।  

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তাদের সংসার চলছে অনেক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে। অনেকে এক বেলা খেলেও অন্য বেলা না খেয়ে থাকছেন। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাতে পারছেন না। বিনা চিকিৎসায় অনেকের জীবনাবসান ঘটেছে। কেউ বা ঝিই-বুয়ার কাজ করে দিনাতিপাত করছেন। মাথা গোজার ঠাঁইও পাচ্ছেন না অনেকেই। অনেক বীরাঙ্গনা ও বিধবা বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। তাদের মধ্যে একজন নুরেমন বেওয়া, তিনি দুই বছর ধরে বিনা চিকিৎসায় শয্যাশায়ী। দিনমনি রাকসাম, হাজেরা বেওয়া  ও লাগজান বেগম। টাকার অভাবে তাদের পরিবার এই বিধবাদের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু মুখে ধাবিত হচ্ছেন তারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোহাগপুর বিধবা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে দুই হাজার করে টাকা বরাদ্দ দেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধু তাদের নামে নামে ২০০০ টাকার চেক পাঠিয়ে দেন। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে বিধবাদের মধ্যে দুটি করে ছাগল, চাল, ডাল ও শাড়ির ব্যবস্থা করেন। পরে দুটি বেসরকারি সংগঠন তাদের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরে আর কোনো সরকার তাদের দিকে নজর দেয়নি। তবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেরপুর জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সোহাগপুর বিধবাপল্লী পুনর্বাসন প্রকল্প নামে কৃষি বনায়ন ও মাশরুম চাষসহ সমন্বিত আয়বর্ধনমূলক কর্মসূচি নেওয়া হয়। কিন্তু সেই কার্যক্রমও পরে বন্ধ হয়ে যায়। সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জালাল উদ্দিন বলেন, আমাদের সমিতির সদস্য সংখ্যা হচ্ছে ৬১ জন। প্রতিষ্ঠার পরে আমরা ২০১৪ সাল পর্যন্ত কয়েকবার সামান্য কিছু সহযোহিতা পেয়েছি। তিনি শহীদ পরিবারের প্রতি নজর দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। সমিতির অন্য সদস্যরা বলেন, সমিতি করে লাভ কি? সরকারের তো কোনো অনুদানও পাই না। এর আগে সামান্য কিছু পেয়েছি তার জন্য ঘুষ দিতে হয়। আর সমিতি অডিট করাতেও টাকা পয়সা লাগে।  কাকরকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শহিদুল্লাহ তালুকদার মুকুল বলেন, ‘বেঁচে থাকা সবাই বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। এলাকার এমপি কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর প্রচেষ্টায় ট্রাস্ট ব্যাংক ও  ব্র্যাক থেকে দুই হাজার ৪০০ টাকা পান বিধবারা। এ ছাড়া  বিধবাভাতা হিসেবে তাদের ৪০০টাকা দেওয়া হয়। এতে তাদের খাবার ব্যবস্থা হলেও টাকার অভাবে তাদের ঠিকমতো চিকিৎসা হয় না। ছয় নির্যাতিত নারীকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিসহ বিধবাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা হলে শেষ জীবনে তারা একটু শান্তি পাবেন। ১৯৭১ সালে ২৫ জুলাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও দেশীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় সোহাগপুরের ১৮৭ জন অধিবাসীকে হত্যা করে। এ সময় ৬২জন বিধবা হন। তাদের মধ্যে বেঁচে আছেন ৩০জন। ৬২ জন বিধবার অনেকেই অবর্ণনীয় কষ্ট বুকে চেপে রেখে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। এখন সেখানে ৩০ জন বিধবার অসহায় বসবাস চলছে। এর মধ্যে ১৪ জন বীরাঙ্গনাও রয়েছেন। নির্যাতনের শিকার ১৪ নারীর মধ্যে ইতিমধ্যে ছয়জনকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। আর দুজন মৃত্যুবরণ করেছেন। জীবিত ছয় বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির আশায় বুক বেঁধে আছেন। আর মৃতদের পক্ষে ছেলে আবেদন করেছেন। স্বীকৃতি পেতে তারা গত ৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন। তারা হলেন— সোহাগপুর গ্রামের  মোছা. করফুলি (৬৯), হাজেরা খাতুন (৬৯), আমেনা বেওয়া (৬৭), মোছা. অজুফা (৮৯), কাকরকান্দি গ্রামের হাছনে আরা (৬৯), মহিরন নেছা (৬৮) ও মৃত জরিতন বেওয়ার (৮১) পক্ষে ছেলে আজগর আলী।

সর্বশেষ খবর