সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

সিলেটে আতঙ্ক উৎকণ্ঠা

নিহতদের পরিবারে শোকের মাতম

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট ও সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

সিলেটে আতঙ্ক উৎকণ্ঠা

নোয়াখালীতে ওসি মনিরুলের স্ত্রীর আহাজারি

আতিয়া মহলের ভিতরে মারা পড়েছে দুই জঙ্গি। জীবিত রয়েছে আরও এক বা একাধিক। কিন্তু এখন ভিতরের চাইতে উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাইরের ‘জঙ্গিরা’।

গত শনিবার রাতে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী পাঠানপাড়া এলাকায় জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলের কয়েকশ গজ দূরে বোমা বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত হওয়ার পর এ উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। আতিয়া মহলের আশপাশ এলাকা ঘিরে জঙ্গিদের অবস্থান থাকতে পারে— এমন আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ও আহত হওয়াদের ব্যাপারেও তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চলাকালেই অভিযানস্থলের সামান্য দূরে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার মাধ্যমে জঙ্গিরা তাদের শক্তিশালী অবস্থানের জানান দিয়েছে। পরিকল্পিত এই হামলায় হতাহত হয়েছেন র‌্যাব-পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ লোকজন।

গত শুক্রবারের আগেও শান্তির নগরী ছিল সিলেট। তবে শুক্রবার সকাল থেকে আতিয়া মহলে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই পাল্টে যায় পরিস্থিতি। আতিয়া মহলে একের পর এক শক্তিশালী বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সিলেট মহানগরীজুড়ে। তবে সেসব ছাপিয়ে আতঙ্ক জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে গত শনিবার সন্ধ্যায় বোমা বিস্ফোরণের পর। এতে ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় সাধারণ মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন। ঘটনার পরপরই নগরীর রাস্তাঘাটে কমে যায় যান ও মানুষ চলাচল। আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন নগরবাসী দ্রুত ফিরে যান ঘরে। নগরীর বাইরে থেকে যারা প্রয়োজনীয় কাজ বা বেড়াতে এসেছিলেন, তারাও দ্রুত ফিরে যান। পরিস্থিতি ক্রমেই হয়ে ওঠে থমথমে। সাধারণ মানুষ মনে করছেন, শিববাড়ীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর তত্পরতার মধ্যে যেভাবে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে জঙ্গিরা, তাতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া শনিবার আতিয়া মহলে যখন অভিযান চলছিল তখন বেশ দূরত্বে অবস্থান করে সংবাদ ও চিত্র ধারণ করছিলেন সাংবাদিকরা। ওই সময় দুই দফায় তাদের মাথার ওপর দিয়ে যায় বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি। রাতে গোটাটিকর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সামনের যে রাস্তায় বোমা বিস্ফোরিত হয়, ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে সেনাবাহিনীর প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নিতে যান ৩০-৪০ জন সাংবাদিক। ব্রিফিং শেষে ওই রাস্তা দিয়ে ফেরার পথেই বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তখন ওই রাস্তায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও ছিলেন। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান তারা। যদিও বিস্ফোরণে আহত হন স্থানীয় একটি দৈনিকের আলোকচিত্রী। তবে দিনে গুলি বর্ষণ ও রাতের বোমা বিস্ফোরণের মধ্যে যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করছেন সাংবাদিকরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে তারা জঙ্গিদের তত্পরতা রুখতে সতর্ক রয়েছেন। কোনোভাবেই নতুন করে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেওয়া হবে না। এ জন্য সিলেটজুড়ে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। বাড়ানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল ও তল্লাশিচৌকি। গতকাল দিনভর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এস এম রোকন উদ্দিন বলেন, ‘বাইরে জঙ্গি থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক রয়েছি।’ শনিবারের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সাধারণ জনতা অভিযানের ব্যাপারে কৌতূহলী ছিল। তারা মনে করেছিল অভিযান শেষ হয়ে গেছে। ঘটনাস্থলের তিন-চারদিকে হাজার হাজার উৎসুক জনতা ভিড় করেছিল। পুলিশ সরিয়ে দেওয়ার পরও তারা ফিরে আসছিল। যখন হামলা হয়, তখন ওই স্থানে প্রচুর লোক ছিল। সেজন্য হামলাকারী শনাক্ত করা যায়নি। তবে নিঃসন্দেহে সেটা ছিল জঙ্গিবাদী কাজ। ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত চলছে, অগ্রগতিও আছে।’ বোমা বিস্ফোরণে নিহতদের মধ্যে কাউকে সন্দেহ করা হচ্ছে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে রোকন উদ্দিন বলেন, ‘তদন্ত করে নিহতদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। স্বজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সিলেটের বাইরের যে দুজন নিহত হয়েছেন, তাদের ব্যাপারেও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। অনুসন্ধান শেষে তাদের লাশ হস্তান্তর করা হবে।’ আহতদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে মন্তব্য করে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘পুরো বিষয়টি তদন্তের মধ্যে আছে। আমরা হামলাকারীদের শনাক্ত করার ব্যাপারে আশাবাদী।’

ডিভি পেয়েও দেশের মায়া ছাড়তে পারেননি : ‘পুলিশে চাকরিরত অবস্থায় আমার বড় ভাই দিপু ২০০৭ সালে ডিভি লটারিতে বিজয়ী হয়ে আমেরিকা গিয়ে দেশের মায়ায় থাকতে পারেননি সেখানে। মাতৃভূমির মায়ায় আমেরিকা থেকে ফেরত এসে আবারও পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন।’ কান্নায় ভেঙে পড়ে ভাই সম্পর্কে এভাবেই বলছিলেন সিলেটে জঙ্গি হামলায় নির্মমভাবে নিহত পুলিশ ইন্সপেক্টর চৌধুরী মোহাম্মদ আবু কয়সর দিপুর ছোট ভাই চৌধুরী আবু জাবেদ নিপু। গতকাল বিকাল ৫টায় সিলেট থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে পুলিশ কর্মকর্তা দিপুর মরদেহ সুনামগঞ্জ শহরের জামাইপাড়ার বাড়িতে এসে পৌঁছায়। শনিবার সন্ধ্যায় পুলিশ কর্মকর্তা দিপুর মৃত্যুর খবর সুনামগঞ্জে এসে পৌঁছার পর পরই বাড়িতে শোকের মাতম শুরু হয়। মরদেহ পৌঁছার পর সেই মাতম বেড়ে যায় বহুগুণ। ৫০ বছর বয়সী এই পুলিশ কর্মকর্তার এই অকালে চলে যাওয়ার বিষয়টি কেউই যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। জঙ্গি হামলায় নিহত পুলিশ ইন্সপেক্টর দিপু সুনামগঞ্জ শহরের জামাইপাড়া এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মৃত মোক্তার আছদ্দর আলী চৌধুরীর ছেলে। সাত ভাই এক বোনের মধ্যে দিপু তৃতীয়। এক সময় সুনামগঞ্জে তিনি জনপ্রিয় ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন। ১৭ বছরের দাম্পত্যজীবনে তার কোনো সন্তান ছিল না। স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের একদিন আগে সেই পরিবারের নিবেদিতপ্রাণ একজন পুলিশ কর্মকর্তা এভাবে জঙ্গিদের হাতে প্রাণ হারাবেন সেটা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয় বলে জানান দিপুর মরদেহ দেখতে আসা স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষীরা। নিহত পুলিশ কর্মকর্তা দিপুর প্রতিবেশী মোজাম্মেল হক মুনিম বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে দিপু ভাইয়ের বাবার আপসহীন ভূমিকার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে হানাদাররা তাদের বাড়িটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মহান স্বাধীনতা দিবসে সেই বাড়িতে আজ শোকের মাতম চলছে- সেট কীভাবে মেনে নেওয়া যায়।

শোকে মুহ্যমান নিহতদের স্বজনরা : সিলেটে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হওয়া ছয় ব্যক্তির পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে চলছে আহাজারি। প্রিয়জন হারিয়ে শোকে মুহ্যমান স্বজনরা। মেনে নিতে পারছেন না প্রিয়জনের এমন চলে যাওয়া। গত শনিবার সন্ধ্যায় সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকায় দুই দফায় বোমা বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত হন। তাদের মধ্যে দুই পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা হচ্ছেন নগরীর জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম ও আদালত পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কায়সার। নিহতের মধ্যে দুই ছাত্রলীগ নেতা ওয়াহিদুল ইসলাম অপু ও জান্নাতুল ফাহিম ছাড়াও নেত্রকোনার শহীদুল ইসলাম ও সুনামগঞ্জের ছাতকের দয়ারবাজার এলাকার কাদিম শাহ রয়েছেন।

শহীদুলের ভাই সাইদুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আটজনের পরিবারে প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল শহীদুল। তার স্ত্রী ও পাঁচ মাস বয়সী একটি বাচ্চা রয়েছে। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, যে ভাইটি জীবিত অবস্থায় ঘর থেকে বের হয়ে গেল, এখন সে ভাইয়ের লাশ আমার সামনে।’ জান্নাতুল ফাহিমের মামা বলেন, ‘সে খুব মেধাবী ছিল। ছাত্রলীগের রাজনীতিও করত। অভিযান শেষ হয়ে গেছে, এমনটা ভেবে কোচিং থেকে ফিরে উৎসুক জনতার সঙ্গে সে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। উচ্ছল এই তরুণটির নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে আছে, এটা মেনে নিতে পারছি না।’ পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের বোন আফরোজা রোজি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের একটি মেয়ে আছে। কোনো সঞ্চয় রেখে যাননি তিনি। ফলে মেয়েটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় আছি।’

নিহত সোহেলের গ্রামের বাড়িতে  শোকের মাতম : সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানস্থলের বাইরে পরপর দুটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত পুলিশের সিলেট সিটি এসবির ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম সোহেল শনিবার  রাত ২টার দিকে জেলার ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। এ পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে তার নোয়াখালীর গ্রামের নিজ বাড়িতে চলছে  শোকের মাতম। নিহত ওসি মনিরুল ইসলাম সোহেল নোয়াখালী সদর উপজেলার এওজবালিয়া ইউনিয়নের (মান্নান নগর বাজার সংলগ্ন) পূর্ব এওজবালিয়া গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের ২য় পুত্র। মনিরুল ইসলাম সোহেল সিলেট সিটি এসবির ওসি তদন্তের দায়িত্বরত অবস্থায় সিলেটে বোমা বিস্ফোরণে গতকাল নিহত হন। তার স্বজনরা জানায়, ঢাকায় ৩ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে মনিরুল ইসলাম সোহেল বৃহস্পতিবার রাতে ছোট ভাইয়ের বিয়েতে যোগ দেওয়ার জন্য দেশের বাড়িতে আসেন। শনিবার কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার পর সে দিন রাতেই বোমা বিস্ফোরণে মনিরুল ইসলাম সোহেল নিহত হন।

মনিরুল ইসলাম সোহেল ২০০৩ সালে সহকারী পরিদর্শক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। মনিরুল ইসলাম সোহেল পার্শ্ববর্তী গ্রাম নুরু পাটোয়ারী এলাকার হাজী নুরুজ্জামানের মেয়ে পারভীন আক্তারকে বিয়ে করেন। বর্তমানে তার দেড় বছরের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। তার স্ত্রী পারভীন আক্তার নোয়াখালী সরকারি কলেজে মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর