সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিধবাদের লেখা বঙ্গবন্ধুর সেই চিঠি

গোলাম রাব্বানী, শেরপুর থেকে ফিরে

বিধবাদের লেখা বঙ্গবন্ধুর সেই চিঠি

বিধবা ও শহীদ পরিবারের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর লেখা চিঠি

“প্রিয় বোন, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিক স্বামীর স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন।”

‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’ থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের নিকট ২০০০ টাকার চেক প্রেরিত হলো। চেক নম্বর (সিএ ০৩৫৫৭৭)। ‘আমার প্রাণ ভরা ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিন। শেখ মুজিব।’

১৯৭৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি শেরপুরের (তৎকালীন ময়মনসিংহ) নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর বিধবাপল্লী ও শহীদ পরিবারের একজন সদস্যের কাছে এই চিঠি লিখেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শহীদ পরিবারের সদস্য আয়জান বেওয়াকে লেখা এই চিঠি যক্ষের ধনের মতো আজও আগলে রেখেছে তার পরিবার। আবেগময় ভাষায় লেখা বঙ্গবন্ধুর সেই চিঠি সোহাগপুর বিধবাপল্লীর নির্যাতিত নারীদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শুধু আয়জান বেওয়াকেই নয়, ওই গ্রামের সব বিধবা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের কাছে এমন চিঠি ও ২০০০ টাকার চেক দিয়ে তাদের সহযোগিতা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত সহানুভূতিপত্র ও দুই হাজার টাকার চেকের কথা আজও ভোলেননি সোহাগপুরের বিধবারা। অনেক বিধবা মৃত্যুবরণ করলেও তাদের পরিবার এই চিঠি সংরক্ষণ করেছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জালাল উদ্দিনের কাছ থেকে এই চিঠির কপি পাওয়া গেছে। শহীদ পরিবারের এই সদস্য যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছে এই চিঠি। দীর্ঘদিন আগের এই চিঠি দেখতে অনেকটা হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। কিছু অক্ষরও অস্পষ্ট হয়েছে। শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, সোহাগপুরের বিধবা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম সহযোগিতা করেছিলেন। এর পরের সরকারগুলো আর খবরও নেইনি। শহীদ পরিবারের সদস্যরা আক্ষেপ করে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য যা করে গেছেন, এরপর আর কোনো সরকার আমাদের জন্য কিছু করেনি। আমরা আশা করছি, বঙ্গবন্ধুকন্যা এই গ্রামের ছয়জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছেন, বাকিদেরও স্বীকৃতি দেবেন এবং শহীদ পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াবেন। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই সকাল বেলা। পাড়ার সব গৃহবধূ গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত। স্বামীদের অনেকেই গৃহস্থালি কেউবা মাঠে কাজ করছিলেন। ওই সময় গ্রামে অতর্কিত হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা। হায়েনার দল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৭৮ জন নিরীহ পুরুষ মানুষকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। সম্ভ্রম লুটে নেয় স্বামীহারা নারীদের। পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে গ্রাম। তখনই গ্রামের নাম হয় ‘বিধবাপল্লী’। এই গ্রামের ৬২ জন বিধবার মধ্যে অবর্ণনীয় কষ্ট বুকে চেপে রেখে অনেকেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। এখন সেখানে ৩০ জন বিধবার অসহায় বসবাস চলছে। এর মধ্যে ১৪ জন বীরাঙ্গনাও রয়েছেন। নির্যাতনের শিকার ১৪ নারীর মধ্যে ইতিমধ্যে ছয়জনকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। আর দুজন মৃত্যুবরণও করেছেন। জীবিত ছয় বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির আশায় বুক বেঁধে আছেন। বিধবারা আজও স্বজনহারানোর ব্যথা বুকে চেপে এই গ্রামে বসবাস করছেন। কিন্তু তাদের জীবন-মানের কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। তবে এখন তারা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে বসে আছেন।

সর্বশেষ খবর