মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

নারীসহ চার জঙ্গি নিহত

ব্যাপক গোলাগুলি । জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সফল অভিযানে কমান্ডোরা । আতিয়া মহল নিয়ন্ত্রণে : সেনাবাহিনী

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট

নারীসহ চার জঙ্গি নিহত

অভিযানে সতর্ক অবস্থান। জঙ্গি আস্তানার ভবনের দেয়াল ভাঙছেন সেনা কমান্ডোরা —আইএসপিআরের ভিডিও থেকে

‘অপারেশন টোয়াইলাইটে’ সফলতা দেখিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোরা। কমান্ডোদের টানা তিন দিনের অভিযানে নিহত হয়েছে চার জঙ্গি। এর মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন মহিলা। দুই জঙ্গির লাশ আতিয়া মহল থেকে বের করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুজনের লাশ সুইসাইডাল ভেস্ট পরা অবস্থায় আতিয়া মহলের ভিতরেই রয়েছে। আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর অভিযানের বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন সেনা সদর দফতরের সামরিক গোয়েন্দা পরিদফতরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। এদিকে আতিয়া মহলে গতকালও গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এ ছাড়া শনিবারের বোমা হামলার ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। বোমা হামলায় নিহত সবার লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রেস ব্রিফিংয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, ‘আতিয়া মহলে চার জঙ্গি নিহত হয়েছে। তন্মধ্যে পুরুষ তিনজন ও মহিলা একজন। একজন করে পুরুষ ও মহিলা জঙ্গির লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুজনের লাশ ভিতরে রয়েছে। তাদের গায়ে সুইসাইডাল ভেস্ট পরা। লাশগুলো আনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। তাদের লাশ বের করে আনতে পরিকল্পনা করছি। ব্যবস্থা নেব।’ তিনি বলেন, ‘আতিয়া মহলের একটি কক্ষে এক জঙ্গির লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। তার পাশে আইইডি বিস্ফোরক আছে। এটা বিস্ফোরিত হলে ভবনের অংশবিশেষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।’ ফখরুল আহসান বলেন, ‘যে চার জঙ্গি ছিল, তাদের খুঁজে বের করে নিষ্ক্রিয় করা তথা হত্যা করা সেনাবাহিনীর বড় সফলতা।’

তিন দিন ধরে ১৭ পদাতিক ডিভিশনের নেতৃত্বে কমান্ডোরা এ অভিযান চালিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা সফল অভিযান করেছেন। জঙ্গিরা খুবই প্রশিক্ষিত ছিল। তাই এ অভিযানে সফল হয়ে আমরা গর্বিত।’ অভিযান অব্যাহত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু সময় লাগতে পারে। ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে সবকিছু চলবে। অভিযান শেষে ক্রাইম সিন হিসেবে আতিয়া মহল পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’ নিহত জঙ্গিদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় কেউ আছে কি না, এমন প্রশ্নে ফখরুল আহসান বলেন, ‘শীর্ষ কেউ আছে কি না তা র‌্যাব ও পুলিশ দেখবে। তারা নমুনা সংগ্রহ করবে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যতটুকু ধারণা, ভিতরে জীবিত কেউ নেই। তবে থাকতেও পারে।’ গতকাল আতিয়া মহলে আগুন ধরার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আতিয়া মহলে ফায়ারিং করা হচ্ছে, গ্রেনেড ছোড়া হচ্ছে, ভিতরে বাসিন্দাদের লেপ, তোশক, বালিশ আছে। সেখান থেকে আগুন ধরেছিল। পরে আমরা তা দ্রুত নিভিয়ে ফেলি।’ অভিযানে সেনাবাহিনীর কেউ আহত হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশবাসীর দোয়ায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আমরা সফলভাবে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়েছি। আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্যও ছিল, ভিতরে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী জঙ্গি রয়েছে। দিন শেষে আমরা চারটি মৃতদেহ পেয়েছি।’ জঙ্গিরা বিস্ফোরক, গ্রেনেড ও স্মল আর্মস দিয়ে শেষ প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। আতিয়া মহলের ওপর সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে উল্লেখ করে ফখরুল আহসান বলেন, ‘ভবনের প্রতিটি কক্ষ কমান্ডোরা তল্লাশি করেছেন। প্রয়োজনে আবারও করবেন।’ জঙ্গিদের শক্তিমত্তার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বাসার নিচতলার কলাপসিবল গেটের সামনে বালতির মধ্যে জঙ্গিরা বিস্ফোরক রেখেছিল। এর বিস্ফোরণ ঘটে কলাপসিবল গেট পাশের বিল্ডিংয়ে গিয়ে উড়ে পড়েছে।’ এদিকে নিহত চার জঙ্গির পরিচয় অভিযানকারী সেনাবাহিনী কর্মকর্তারা জানাতে পারেননি। যে দুটি লাশ পুলিশ গ্রহণ করেছে, তাদেরও পরিচয় দিতে পারেনি পুলিশ। তবে ধারণা করা হচ্ছে, যে নারী জঙ্গির লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে, তা কথিত মর্জিনার হতে পারে।

গুলি-বিস্ফোরণ ছিল কালও : টানা চতুর্থ দিনের মতো গতকালও আতিয়া মহল থেকে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। গতকাল ভোর সাড়ে ৬টার দিকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। এরপর থেমে থেমে কয়েকবার গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। বেলা ১টা ৫৫ মিনিট থেকে আতিয়া মহলে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। বেলা ২টা ৩ মিনিটে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা। এরপর টানা কয়েক মিনিট গুলির শব্দ শোনা গেছে। বিকালেও ভবনটির ভিতর বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ শোনা যায়। এরপর ভবনের ওপর দিয়ে কালো ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। সেনা কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, জঙ্গিদের সুইসাইডাল ভেস্ট বিস্ফোরণে বাসার ভিতরে থাকা আসবাবপত্র ও লেপ-তোশক থেকে এ আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল।

ঘটনাস্থলে ক্রাইম সিন ইউনিট : আতিয়া মহলের বাইরে শনিবার বোমা বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনাস্থল থেকে গতকাল আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট। বিকাল সোয়া ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত আলামত সংগ্রহ করা হয়। তবে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট আতিয়া মহলের ভিতরে প্রবেশ করেনি।

বোমা হামলার ঘটনায় মামলা : আতিয়া মহলের প্রায় আড়াইশ গজ দূরে শনিবার বোমা বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। নগরীর মোগলাবাজার থানায় এসআই শিবলু চৌধুরী বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। আসামির সংখ্যাও উল্লেখ করা হয়নি। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এস এম রোকন উদ্দিন জানান, বোমা হামলার ঘটনায় দণ্ডবিধির ৩০২ ও ৩৪ ধারায় এবং বিস্ফোরক আইনের ৩ ও ৪ ধারায় অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা হয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে পাঁচটি মোটরসাইকেল পাওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে চারটির মালিক পাওয়া গেছে। একটির মালিককে পাওয়া যায়নি। মোটরসাইকেলের মালিক শনাক্তের জন্য বিআরটিএর সাহায্য চাওয়া হয়েছে। সিলেট নগরবাসীর নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তত্পর রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা এ বোমা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের খুঁজে বের করতে তদন্ত চলছে। নিশ্চয়ই তারা ধরা পড়বে।

বোমা হামলায় নিহত দুজনের লাশ হস্তান্তর : শনিবার বোমা বিস্ফোরণে নিহত দুজনের লাশ ওসমানী হাসপাতালের মর্গে ছিল। গতকাল স্বজনদের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই দুজন হচ্ছেন নেত্রকোনার শহীদুল ইসলাম ও সুনামগঞ্জের ছাতকের দয়ার বাজার এলাকার কাদিম শাহ। এ দুজন নগরীর দাড়িয়াপাড়ায় ডেকোরেটরের ব্যবসা করতেন। এর আগে রবিবার নিহত অপর চারজনের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

প্রসঙ্গত, প্রায় তিন মাস আগে একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা পরিচয়ে আতিয়া মহলের নিচতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন কাওছার নামের একজন। সঙ্গে তার স্ত্রী মর্জিনা ছিলেন। তবে নাম দুটি সঠিক ছিল কি না তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কাওছার নামক ব্যক্তির ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটটি জঙ্গি ঘাঁটি এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে আতিয়া মহল ঘেরাও করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিষয়টি টের পেয়ে শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে ভিতর থেকে দুটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। ওই দিন বিকালে অভিযানে যোগ দেয় সোয়াত। রাতে ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণে আসেন সেনা কমান্ডোরা। বিস্ফোরক দিয়ে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলায় এবং পাঁচতলা ভবনের ২৯টি ফ্ল্যাটে নিরীহ লোকজন থাকায় অভিযানের দায়িত্ব পড়ে সেনা কমান্ডোদের ওপর। শনিবার সকাল সোয়া ৯টা থেকে অভিযান শুরু করেন কমান্ডোরা। বেলা ২টার মধ্যে তারা ওই সব ফ্ল্যাট থেকে ৭৮ জন বাসিন্দাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে আসেন। সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ উদ্ধার অভিযানই ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এতে সফল হলে বেলা ২টার পর থেকে শুরু হয় জঙ্গি দমন অভিযান। শনিবার সেনাবাহিনীর প্রেস ব্রিফিংয়ের কিছুক্ষণ পরই আতিয়া মহলের অদূরে দুই দফায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হন। সেনাবাহিনী রবিবার দুই জঙ্গি নিহত হওয়ার তথ্য দেয়। পরে গতকাল সন্ধ্যায় ভিতরে থাকা চার জঙ্গির নিহত হওয়ার বিষয়টি জানায় সেনাবাহিনী।

নিহত পুলিশ পরিদর্শক মনিরুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন : নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, স্বজনদের চোখে জল আর বিউগলের করুণ সুরের মধ্য দিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সিলেটে বোমা বিস্ফোরণে নিহত পুলিশ পরিদর্শক মো. মনিরুল ইসলাম সোহেল। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় নোয়াখালী সদর উপজেলার মন্নান নগর মডেল একাডেমি মাঠে নিহতের শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন ও রাষ্ট্রীয় সালামের মধ্য দিয়ে তাকে বিদায় জানানো হয়। এ সময় এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। জানাজায় নোয়াখালী পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের কমান্ড্যান্ট মো. হাবিবুর রহমান, পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াছ শরীফসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। পরে পূর্ব এওজবালিয়া গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

গ্রামের বাড়িতে শোকের মাতম : এদিকে রবিবার রাত সোয়া ১১টার দিকে সোহেলের মরদেহ নোয়াখালীর সদর উপজেলার পূর্ব এওজবালিয়া গ্রামে তার নিজ বাড়িতে এসে পৌঁছে। সিলেটে দুটি জানাজা শেষে অ্যাম্বুলেন্সযোগে পুলিশ তার মরদেহ নিয়ে আসে। এ সময় তার স্বজন ছাড়াও এলাকার শত শত মানুষ প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মতো দেখতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

নিহত ওসি মনিরুল ইসলাম সোহেল নোয়াখালী সদর উপজেলার এওজবালিয়া ইউনিয়নের (মান্নান নগর বাজার সংলগ্ন) পূর্ব এওজবালিয়া গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের দ্বিতীয় পুত্র। তিনি সিলেট সিটি এসবির ওসি তদন্তের দায়িত্বরত অবস্থায় সিলেটে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। তার স্ত্রী পারভিন আক্তার নোয়াখালী সরকারি কলেজে মাস্টার্স শেষবর্ষের ছাত্রী। তাদের দেড় বছরের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। তার স্বজনরা জানান, ঢাকায় তিন দিনের প্রশিক্ষণ শেষে মনিরুল ইসলাম সোহেল বৃহস্পতিবার রাতে ছোট ভাইয়ের বিয়েতে যোগ দেওয়ার জন্য গ্রামের বাড়িতে আসে। শনিবার কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার পর সেদিন রাতেই বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। প্রয়াত নুরুল ইসলাম ডাক্তারের চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর