বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে র‍্যাব গোয়েন্দা প্রধান

সিলেটে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গুরুতর আহতের পর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে, আজ চিকিৎসকদের চূড়ান্ত ঘোষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক

জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে র‍্যাব গোয়েন্দা প্রধান

লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ

জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে র‍্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। গতকাল রাত ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে সেনাবাহিনীর দুঃসাহসী এই প্যারা কমান্ডো ছিলেন লাইফ সাপোর্টে। আজ সকাল ৬টায় (বাংলাদেশ সময়) সিঙ্গাপুরের প্যারাগন মেডিকেল সেন্টারের নিউরো বিশেষজ্ঞ ডা. ম্যাথিউকে শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবেন। গত শনিবার সিলেটের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালাতে গিয়ে বোমার আঘাতে আহত হওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত লাইফ সাপোর্টেই রাখা হয়েছে তাকে। এই সেনা কর্মকর্তা সুস্থ হয়ে ফিরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এ যোগদান করে দেশসেবায় অবদান রাখবেন এমনটাই প্রত্যাশা তার পরিবার, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের। সৃষ্টিকর্তার কাছে এই বীর সেনানীর সুস্থতা চেয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভরে গেছে স্ট্যাটাসে। শনিবার সন্ধ্যায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমার জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহলে’ অভিযানস্থলে গিয়ে শক্তিশালী বোমা হামলার শিকার হন এই র‍্যাব কর্মকর্তা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে রাতেই ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে আসা হয়। সিঙ্গাপুরে নেওয়ার আগ পর্যন্ত লে. কর্নেল আজাদ সিএমএইচ-এর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। রবিবার সন্ধ্যায় তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এই সেনা কর্মকর্তার চিকিৎসার ব্যাপারে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখা হচ্ছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। সিলেটে জঙ্গিদের অবস্থানের খবর পেয়ে কর্তব্য পালনে সেখানে ছুটে যান আজাদ। র‍্যাবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে তার সাহসী ভূমিকা দেশ-বিদেশে প্রশংসিত ছিল। শুক্রবার রাতে সিলেটের আতিয়া মহলে অপারেশনের দায়িত্বভার সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা নেওয়ার পরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন সিলেট যাওয়ার। নিজে প্যারা কমান্ডো হওয়ায় নিজের সহকর্মীদের সঙ্গে অপারেশনে অংশ নিতেই তার এই সিদ্ধান্ত ছিল বলে তার সহকর্মীরা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। গত বছর রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় প্যারা কমান্ডোদের অপারেশন থান্ডারবোল্ট-এ ও এই কমান্ডোর বিশেষ ভূমিকা ছিল। চলতি বছর হলি আর্টিজানে বিশেষ ভূমিকার কারণে প্রশংসিত হন। এর আগে জঙ্গিবাদ এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকার জন্য বিপিএম (বাংলাদেশ পুলিশ পদক) এবং পিপিএম (প্রেসিডেন্ট পদক) পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

যেভাবে সিলেট গেলেন : রাজধানীর আশকোনায় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপরীতে পুলিশ চেকপোস্টে বোমা বিস্ফোরণে এক যুবক নিহত হওয়ার পর সারা রাত দেশের বিভিন্ন এলাকায় র‍্যাবের অভিযান সমন্বয় করেন তিনি। সিলেটের আতিয়া মহলের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা দায়িত্ব নেওয়ার পর সেখানে ছুটে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখান লে. কর্নেল আজাদ। তার সহকর্মীরা বলছিলেন, নিজে কমান্ডো হওয়ার কারণেই সিলেটে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করছিলেন তিনি। র‍্যাবের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পরই তাড়াহুড়ো করে সিলেটে যাওয়ার বিমান টিকিট সংগ্রহ করান তিনি। জুনিয়র সহকর্মী মেজর আজাদকে নিয়ে ছুটে যান সিলেটের আতিয়া মহলের অভিযানে। জঙ্গিবাদ দমনে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনান অভিযানের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র এবং পরিচিত সহযোদ্ধা কমান্ডোদের। সারাদিন সেখানে অবস্থান শেষে রাতেই তার ঢাকায় ফিরে আসার কথা ছিল। সে অনুযায়ী ঘটনাস্থল ত্যাগ করার প্রস্তুতিও নেন তিনি এবং তার অধস্তন মেজর আজাদ। গাড়িতে ওঠার সময়ই লে. কর্নেল আজাদের চোখ পড়ে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক চৌধুরী আবু মোহম্মদ কয়সর এবং জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলামের তল্লাশির দৃশ্যে। এ সময় তাদের ডেকে বলছিলেন, এভাবে তল্লাশি করা ঠিক না। প্রশিক্ষিত বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সহায়তা নেওয়ার জন্য বলেন তিনি। তার মুখের কথা শেষ না হতেই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় বোমাটি। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দুই পুলিশ পরিদর্শক, লে. কর্নেল আজাদ, মেজর আজাদসহ অন্তত ১০ জন। একটি স্প্লিন্টার তার চোখ দিয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। গুরুতর অবস্থায় তাদের নেওয়া হয় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় এই দুই সেনাকর্মকর্তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে আসা হয়। পরদিন উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে।

এই সেনা কর্মকর্তার কাছ থেকে বিভিন্ন সময় সহযোগিতা পেয়েছেন এমন অনেকেই এ প্রতিবেদককে বলেছেন, অনেক অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল ছিলেন লে. কর্নেল আজাদ। তার কাছে গিয়ে কেউ খালি হাতে ফেরেননি। নিজে কিছু না করতে পারলেও অন্তত যেখানে গেলে তারা সহায়তা পাবেন সেখানে নিজ উদ্যোগে বলে দিতেন তিনি।

লে. কর্নেল আজাদের পারিবারিক নাম রাসেল। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি পড়াশোনা করেছেন বিকেএসপি-তে। তবে বেড়ে উঠেছেন আগারগাঁও তালতলার ছয়তলা সরকারি কলোনিতে। ওই কলোনিরই ওই সময়ের বাসিন্দা বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবী শাহ্ হান্নান মাহ্বুব (পল্লব) এ প্রতিবেদককে বলেন, ১৯৮৪ সাল থেকে শতদল-ঘ ভবনের ৩০৪ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকতেন রাসেল ভাইরা (লে. কর্নেল আজাদের পারিবারিক নাম)। আমরা থাকতাম ৪০৪ এ। রাসেল ভাইয়ের আহত হওয়ার খবর শোনার পর থেকে কোনো কাজে মন বসাতে পারছি না। এমন ভালো মানুষ আমার জীবনে কম দেখেছি। তার কাছে ধনী-গরিবের কোনো ব্যবধান নেই। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরও মাঝে মাঝেই ছুটে আসতেন কলোনিতে। সৃষ্টিকর্তার কাছে রাসেল ভাইয়ের জীবন ভিক্ষা করছি। কলোনির মসজিদে রাসেল ভাইয়ের জন্য প্রার্থনা হচ্ছে। আমার বিশ্বাস আমাদের মাঝে আবার ফিরে আসবে। সিঙ্গাপুরে সেনা কর্মকর্তা আজাদের চিকিৎসার খোঁজখবর রাখছেন সরকারের এমন এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, আজাদের অবস্থা সংকটাপন্ন। তবে চিকিৎসকরা এখনো আশা ছাড়েননি। একটা মিরাকলের প্রত্যাশা করছেন তারা।

জানা গেছে, কমান্ডো আজাদ শনিবার সিলেট মহানগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ীতে সেনা নেতৃত্বে জঙ্গি নির্মূল অভিযানে অংশ নিতে যান। সন্ধ্যায়ই তার ঢাকা ফেরার কথা ছিল। বিকালে অভিযানস্থলের অদূরে পড়ে থাকা একটি বস্তায় বিভিন্ন সরঞ্জামাদি পরখ করে দেখছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তা পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কয়সরসহ অন্যরা। এ সময় বিচ্ছিন্নভাবে পুলিশের সদস্যদের সরঞ্জামাদি দেখতে নিষেধ করছিলেন র‍্যাবের গোয়েন্দা প্রধান আজাদ। কথা বলা শেষ হওয়া মাত্রই বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় বোমাটি। ঘটনাস্থলেই নিহত হন পুলিশের ওই পরিদর্শক। গুরুতর আহত হন লে. কর্নেল আজাদ, মেজর আজাদসহ অন্তত ১০ জন। তাৎক্ষণিকভাবে গুরুতর অবস্থায় লে. কর্নেল আজাদকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার কয়েক দফা অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে ঢাকা সিএমএইচ-এ নিয়ে আসার পর তাকে গঠন করা হয় উচ্চপর্যায়ের মেডিকেল বোর্ড।  প্রসঙ্গত, লে. কর্নেল আজাদ বিএমএ ৩৪ লং কোর্সের মাধ্যমে ৫ জুলাই ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ২৬ অক্টোবর ২০১১ সালে মেজর থাকাবস্থায় র‍্যাবে যোগ দেন। তৎকালীন র‍্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) এর তত্ত্বাবধানে কাজ করেন গোয়েন্দা শাখায়। একের পর এক সফল অপারেশন করে অপরাধীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন এই সেনা কমান্ডো। র‍্যাবে কর্মরত অবস্থাতেই তিনি লে. কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর র‍্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। গত বছর রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কমান্ডো লে. কর্নেল আজাদ। সম্প্রতি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ—বিজিবিতে তার পোস্টিং হয়। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের পরই আনুষ্ঠানিকভাবে লে. কর্নেল আজাদের র‍্যাব থেকে বিজিবিতে যোগদানের কথা।

 

সর্বশেষ খবর