বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

সমাপ্ত অপারেশন টোয়াইলাইট

নিহতদের মধ্যে জঙ্গি মুসা

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

সমাপ্ত অপারেশন টোয়াইলাইট

সিলেটের আলোচিত ভবন আতিয়া মহলের নিচ তলা থেকে চার তলা পর্যন্ত তুমুল লড়াইয়ের চিহ্ন। উড়ে গেছে জানালার কপাট, ভেঙে গেছে কাচ। বোমার তীব্রতায় বেঁকে গেছে লোহার গ্রিলও। —বাংলাদেশ প্রতিদিন

যে লক্ষ্য নিয়ে সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ কমান্ডোরা ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শুরু করেছিলেন, সে লক্ষ্যে তারা পুরোপুরি সফল হয়েছেন। গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া সেনা কমান্ডোদের এ অভিযান গতকাল বিকালে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। অপারেশন টোয়াইলাইটে চার জঙ্গিকে নির্মূল করেছেন সেনা কমান্ডোরা। এ অভিযান মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। এদিকে গতকাল আতিয়া মহলে নিহত দুই জঙ্গির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তাদের ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করে লাশ ওসমানী হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। বিকালে আতিয়া মহল পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী। এদিকে গত রাতে এক ব্রিফিংয়ে অপারেশন টোয়াইলাইট মাইলফলক হয়ে থাকবে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। জঙ্গিরা অবস্থান করছে, এমনটা নিশ্চিত হয়ে সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী পাঠানপাড়ার আতিয়া মহল গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আনুমানিক ৩টায় ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুক্রবার বিকালে অভিযানে যোগ দেয় সোয়াত। তবে পুলিশ বা সোয়াত সদস্যরা পাঁচতলা ওই ভবনে থাকা বাসিন্দাদের নিরাপত্তা ও বিস্ফোরকের ঝুঁকিসহ নানা দিক বিশ্লেষণ করে অভিযানে সেনাবাহিনীর সাহায্য চান। শনিবার সকাল থেকে সেনা কমান্ডোরা শুরু করেন ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। অভিযানের দুটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেন সেনা কমান্ডোরা। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল আতিয়া মহলে আটকাপড়া নিরীহ বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে আনা। অন্যটি ছিল জঙ্গিদের নির্মূল করা। কমান্ডোরা অভিযানের শুরুতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আতিয়া মহলে আটকাপড়াদের উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পাশের চারতলা ভবন থেকে পাঁচতলা ভবনে মই লাগিয়ে একে একে উদ্ধার করা হয় ৭৮ বাসিন্দাকে। তন্মধ্যে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন মহিলা ও ২১টি শিশু ছিল। জঙ্গিরা আতিয়া মহলের বিভিন্ন স্থানে রূপান্তরিত বিস্ফোরক (আইইডি) লাগিয়ে রাখায় এ উদ্ধার অভিযান ছিল চরম ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু কোনো ধরনের হতাহতের ঘটনা ছাড়াই সব বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে আনতে সক্ষম হন কমান্ডোরা।

প্রথম লক্ষ্যে সফল হওয়ার পর দ্বিতীয় লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন সেনা কমান্ডোরা। কমান্ডোদের সঙ্গে স্নাইপার দল এপিসিসহ বিশেষায়িত অনেক সদস্য ছিলেন। সেনা কমান্ডোদের বিরুদ্ধে জঙ্গিরা গ্রেনেড, রূপান্তরিত বিস্ফোরক, স্মল আর্মস দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে। একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। তবে দুর্ধর্ষ কমান্ডোদের দুঃসাহসী অভিযানে পরাস্ত হয় জঙ্গিরা। একে একে আতিয়া মহলের চার জঙ্গিই নিহত হয়। নিজেদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই দ্বিতীয় লক্ষ্যেও সফল হন সেনা কমান্ডোরা।

দুই জঙ্গির ময়নাতদন্ত : আতিয়া মহলে নিহত চার জঙ্গির মধ্যে দুজনের ময়নাতদন্ত গতকাল সম্পন্ন হয়েছে। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে এক পুরুষ ও এক নারী জঙ্গির লাশ ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শামসুল আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যের বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের অপর দুই সদস্য হচ্ছেন ডা. তাহমিনা আক্তার ও নাদিয়া শারমিন। বেলা ১২টার কিছুক্ষণ পর শুরু হয় ময়নাতদন্ত। এক পুরুষ জঙ্গির ময়নাতদন্ত শেষ হয় বেলা ২টা ৪০ মিনিটে। পরে বিকাল পৌনে ৪টায় শেষ হয় নারী জঙ্গির ময়নাতদন্ত। লাশ দুটি ওসমানী হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।

পরিচয় শনাক্তে ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ : নিহত জঙ্গিদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ টেস্ট করা হবে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জেদান আল মুসা। তিনি বলেন, নিহত জঙ্গিদের ডিএনএর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ভিসেরা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হবে। পরিচয় শনাক্ত হলে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে। অন্যথায় বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করা হবে।

কালও বিস্ফোরণের শব্দ : আতিয়া মহল থেকে গতকালও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। পুরো দিনে ১০টি বড় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। তবে সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জঙ্গিদের রাখা বোমা নিষ্ক্রিয় করার সময় এ শব্দগুলো হয়েছে।

আতিয়া মহলের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ : সেনা কমান্ডোরা আতিয়া মহলের নিয়ন্ত্রণ পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে পুলিশ আতিয়া মহল বুঝে নেয়। একই সঙ্গে আতিয়া মহলের ভিতরে থাকা লাশ দুটিও পুলিশকে হস্তান্তর করে সেনাবাহিনী।

বোমা হামলা মামলায় গ্রেফতার নেই : আতিয়া মহলে অভিযান চলাকালে গত শনিবার সামান্য দূরে দুই দফায় বোমা হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। গতকাল রাত সোয়া ৮টার দিকে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জেদান আল মুসা এ তথ্য জানিয়েছেন।

মানুষের দুর্ভোগ : আতিয়া মহলে যেদিন থেকে অভিযান শুরু হলো, সেদিন থেকেই পুরো শিববাড়ী এলাকার মানুষের দুর্ভোগের শুরু। অভিযানকালে এলাকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। আজ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ পুনরায় চালু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে, দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন রশীদ চত্বর থেকে পীর হাবিবুর রহমান চত্বর পর্যন্ত এলাকায় যানবাহন চলাচলে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল পুলিশ, গতকাল রাত সাড়ে ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তা বলবৎ রয়েছে। প্রসঙ্গত, প্রায় তিন মাস আগে একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা পরিচয়ে আতিয়া মহলের নিচতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় কাওছার নামের একজন। সঙ্গে তার স্ত্রী মর্জিনা ছিলেন। তবে নাম দুটি সঠিক ছিল কিনা তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কাওছার নামক ব্যক্তির ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটটি জঙ্গি ঘাঁটি, এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে আতিয়া মহল ঘেরাও করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিষয়টি টের পেয়ে শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে ভিতর থেকে দুটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। ওইদিন বিকালে অভিযানে যোগ দেয় সোয়াত। রাতে ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণে আসে সেনা কমান্ডোরা। বিস্ফোরক দিয়ে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলায় এবং পাঁচতলা ভবনের ২৯টি ফ্ল্যাটে নিরীহ লোকজন থাকায় অভিযানের দায়িত্ব পড়ে সেনা কমান্ডোদের ওপর। শনিবার সকাল সোয়া ৯টা থেকে অভিযান শুরু করেন কমান্ডোরা। বেলা ২টার মধ্যে তারা ওইসব ফ্ল্যাট থেকে ৭৮ জন বাসিন্দাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে আসেন। সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ উদ্ধার অভিযানই ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাতে সফল হওয়ার পর বেলা ২টার পর থেকে শুরু হয় জঙ্গি দমন অভিযান। শনিবার সেনাবাহিনীর প্রেস ব্রিফিংয়ের কিছুক্ষণ পরেই আতিয়া মহলের অদূরে দুই দফায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হন। গত রবিবার দুই জঙ্গি নিহত হওয়ার তথ্য দেয় সেনাবাহিনী। পরে গত সোমবার সন্ধ্যায় ভিতরে থাকা চার জঙ্গির নিহত হওয়ার বিষয়টি জানায় সেনাবাহিনী। গতকাল আতিয়া মহল পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে অপারেশন টোয়াইলাইট সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।

অপারেশন টোয়াইলাইট মাইলফলক হয়ে থাকবে : জঙ্গি দমনসহ যে কোনো ক্রাইসিস মোকাবিলায় সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাইলফলক হয়ে থাকবে অপারেশন টোয়াইলাইট। এমন মন্তব্য সেনা সদর দফতরের গোয়েন্দা পরিদফতরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসানের। গতকাল রাত ৮টায় সিলেট জালালাবাদ সেনানিবাসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এমন মন্তব্য করেন তিনি। এ প্রেস ব্রিফিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ীর পাঠানপাড়ার আতিয়া মহলে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনার আলোকে সেনাবাহিনী অপারেশন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। অপারেশনে মূলত দুটি প্রায়োরিটি নির্ধারণ করা হয়। প্রথমত, ভবনের বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, জঙ্গিদের নির্মূল করা। প্রথম পর্বটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।  কমান্ডোরা তাদের জীবন বাজি রেখে ২৫ মার্চ দুপুরে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন মহিলা ও ২১ শিশুকে নিরাপদে উদ্ধার করেন। এ পর্বটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এরপর জঙ্গিদের নির্মূল করার অভিযান শুরু হয়। এ পর্বে কমান্ডোদের পাশাপাশি স্নাইপার দল এপিসিসহ বিশেষায়িত অনেক সদস্য নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন। তিন দিন একটানা বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ২৭ মার্চ বিকালের মধ্যে চার জঙ্গিকে নির্মূল করা হয়। মূলত সোমবারই অভিযান শেষ হয়, তবে আরও তল্লাশি ও নিশ্চিত হওয়ার জন্য গতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। গতকাল দুটি মৃতদেহ পুলিশ প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকি দুটি মৃতদেহ সুইসাইডাল ভেস্টসহ থাকায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। নিরাপত্তা বিবেচনায় ও পুলিশ প্রশাসনের পরামর্শে সোমবারই সেগুলোর বিস্ফোরণ করা হয়। ফখরুল আহসান বলেন, ভিতরের জঙ্গিরা বেশ ভালো প্রশিক্ষিত ছিল। ভিতরে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকও ছিল। বিস্ফোরক দিয়ে তারা পুরো ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ করে রেখেছিল। ভবনের ১৫০টি কক্ষের মধ্যে কোথায় তারা কী রেখেছে, তা শনাক্ত করাও ছিল বেশ কঠিন।

গায়ে আগুন লাগিয়ে মর্জিনার, আত্মঘাতী হয়ে কাওছারের মৃত্যু : আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডোদের দুর্ধর্ষ অভিযানের মুখে গায়ে আগুন দিয়ে মারা গেছেন নারী জঙ্গি কথিত মর্জিনা বেগম। অন্যদিকে আত্মঘাতী হয়ে মৃত্যু হয়েছে কাওছার বলে ধারণা করা এক পুরুষ জঙ্গির। সুরতহাল প্রতিবেদনে মর্জিনা ও কাওছারের মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়েছে এভাবেই। নিহত চার জঙ্গির মধ্যে এ দুজনের ময়নাতদন্ত গতকাল সম্পন্ন হয়। এর আগে লাশ দুটির সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে পুলিশ।

নিহত দুই জঙ্গির সুরতহাল প্রতিবেদনের কপি বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতে এসেছে। সুরতহাল প্রতিবেদনে দেখা যায়, নারী জঙ্গির (মর্জিনা) উচ্চতা আনুমানিক চার ফুট। তার মাথায় সামান্য চুল রয়েছে, ওপরের পাটির দাঁত দেখা যায়। লাশের মুখমণ্ডল, দুই হাত ও দুই পায়ের গিরা পর্যন্ত সম্পূর্ণ পোড়ানো। অর্থাৎ লাশটি সম্পূর্ণই পোড়ানো এবং বাইরে থেকে কঙ্কাল দৃশ্যমান বলেও সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

মোগলাবাজার থানার এসআই সুজাত দত্তের করা সুরতহাল প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ রয়েছে, লাশের একটি পায়ে সামান্য মাংস রয়েছে এবং পায়ের তালুর নিচে আনুমানিক দুই ইঞ্চি কাটা। বুকের গড়ন ও পা দেখে এটি নারীর লাশ বলে শনাক্ত করা হয়েছে।

এই নারীকে একজন ‘জঙ্গি সন্ত্রাসী’ উল্লেখ করে সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে সে। এদিকে নিহত পুরুষ জঙ্গির সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মোগলাবাজার থানার এসআই সোহেল রানা। তার তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অজ্ঞাতনামা পুরুষটি লম্বায় আনুমানিক পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, মুখমণ্ডল গোলাকার ও আগুনে পোড়া। লাশের কান দুটি স্বাভাবিক রয়েছে ও মাথায় সামান্য চুল আছে। ডান চোখ খোলা, ওপরে ভ্রূ রয়েছে। মুখে সামান্য দাড়ি দৃশ্যমান। দুই হাত শরীরের সঙ্গে মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় লাগানো। লাশটির বুক থেকে তলপেট পর্যন্ত পুরোটাই ছিন্নবিচ্ছিন্ন, গায়ে কালো জামা ও পায়ে কালো জুতা রয়েছে। বাঁ পায়ের মাংস টাকনু বরাবর কাটা উল্লেখ করে সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাশের দুই রান স্বাভাবিক রয়েছে। ডান পায়ে কালো প্যান্টের অংশ আছে।

লাশটি ‘জঙ্গি সন্ত্রাসীর প্রতীয়মান হয়’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ সন্ত্রাসী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার এড়াতে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে মারা গেছে।

প্রসঙ্গত, সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী পাঠানপাড়ায় আতিয়া মহলে কমান্ডোদের অভিযানে চার জঙ্গি নিহত হয় বলে তথ্য দেয় সেনাবাহিনী। সোমবার এক নারী ও এক পুরুষ জঙ্গির লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে গতকাল আতিয়া মহলসহ আরও দুই পুরুষ জঙ্গির লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সিলেটে নিহত নারী জঙ্গি বান্দরবানের মর্জিনা! : বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকার জঙ্গি আস্তানায় মনজিয়ারা পারভিন ওরফে মর্জিনা বান্দরবানের বাইশারীর মর্জিনা বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করেছে নিহতের পরিবার। তবে আরও নিশ্চিত হতে নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন মর্জিনা পরিবারের সদস্যরা। মনজিয়ারা পারভিন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে নিহত জঙ্গি জুবাইরা ইয়াসমিনের ছোট বোন।

সূত্র জানায়, সিলেটের মর্জিনাই বান্দরবানের মনজিয়ারা পারভিন কিনা এটা নিশ্চিত হতে গতকাল সকালে সিলেট পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে বান্দরবান জেলা পুলিশকে বার্তা পাঠানো হয়। এ বার্তা পেয়ে বান্দরবান জেলা পুলিশ মনজিয়ারা পারভিনের পরিবারের দুই সদস্যকে সিলেট পুলিশের কাছে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। সীতাকুণ্ডে এই পরিবারের আরেক সদস্য জহিরুল হক জসিমকেও জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক আবু মুসা বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুসারে পুলিশের সহায়তায় তাদের সিলেট পাঠানো হয়েছে।

জানা গেছে, জঙ্গি জুবাইরা ইয়াসমিন ও মনজিয়ারা পারভিনের বাবা নুরুল ইসলাম এবং বড় ভাই জিয়াবুল হক গতকাল দুপুরের দিকে সিলেটের উদ্দেশে বান্দরবান ত্যাগ করেন। সিলেটের আতিয়া মহলে নিহত জঙ্গি মর্জিনা তাদের পরিবারের সদস্য কি না তা নিশ্চিত করবেন তারা। জাতীয় পরিচয়পত্রের সূত্রে জানা যায়, মনজিয়ারা বেগমের জন্ম ১৯৯৩ সালের ৩ এপ্রিল। বাবার নাম নুরুল আমিন, মায়ের নাম সাবেকুর নাহার। তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী ২৭৮ নম্বর মৌজার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা।

স্থানীয় সূত্র জানায়, মনজিয়ারা বেগমের বাবার নাম নুরুল আলম ও মায়ের নাম জান্নাত আরা। ২৭৮ নম্বর মৌজার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী বাবা-মার নাম ও ওয়ার্ডে গরমিল দেখা গেছে।

বান্দরবানের পুলিশ সুপার সঞ্চিত কুমার রায় বলেন, নিহত মর্জিনাই মনজিয়ারা কি না তার লাশ ও পোশাক দেখে নিশ্চিত হতে পরিবারের দুই সদস্যকে সিলেট পাঠানো হয়েছে।

এদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির জঙ্গি জুবাইরা ইয়াসমিন ও কামালের পরিবারের ছয় ব্যক্তি নিখোঁজ থাকায় স্থানীয়দের মধ্যে চরম আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ কারণে উপজেলায় গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয়দের তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ।

নাইক্ষ্যংছড়ির স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জুবাইরা ইয়াসমিন ও তার ভাই জহিরুল হক জসিমের বাড়ি নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের যৌথ খামারপাড়ায়। তারা সেখানে বসবাসকারী নুরুল আলম ও জান্নাত আরার সন্তান। জুবাইরা ইয়াসমিনের স্বামী কামাল হোসেনের বাড়িও বাইশারীর যৌথ খামারপাড়ায়।

জুবাইরা ইয়াসমিনের মা জান্নাত আরা বলেন, ‘তার আট ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে তিনজনের কোনো হদিস নেই। জুবাইরা ইয়াসমিনকে স্বামী কামাল হোসেন নিয়ে যায়। কিছুদিন পর ছেলে জহিরুল হকও তাদের সঙ্গে চলে যায়। জুবাইরার একটি ছেলে হলে সন্তানের দেখাশোনার কথা বলে তারা আমার আরেক মেয়ে মনজিয়ারা বেগমকে (১৬) চট্টগ্রামে নিয়ে যায়।’ আট মাস ধরে তাদের কোনো খবর পান না বলেও তিনি জানান। কামাল ও জুবাইরা বেশ ধার্মিক ছিল বলে জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর