বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

এবার মৌলভীবাজারে অভিযান

দুই জঙ্গি আস্তানায় ব্যাপক গোলাগুলি, কুমিল্লায়ও একটি বাড়ি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

শাহ্ দিদার আলম নবেল ও সৈয়দ বয়তুল আলী, মৌলভীবাজার থেকে

এবার মৌলভীবাজারে অভিযান

মৌলভীবাজারে এই বাড়িতে আছে বেশ কয়েকজন জঙ্গি, বলছে পুলিশ

সিলেটের আতিয়া মহলে সেনা কমান্ডোদের শ্বাসরুদ্ধকর জঙ্গিবিরোধী অভিযানের রেশ কাটতে না কাটতে এবার পার্শ্ববর্তী জেলা মৌলভীবাজারে দুটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাট ও জেলার খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুর গ্রামে এ দুই জঙ্গি আস্তানায় গতকাল দিনভর অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিকেলে অভিযানে যোগ দেয় বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াত। এ অভিযানে কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা গেছে। একটি অসমর্থিত সূত্র জানায়, প্রাণহানির সংখ্যা ছয় হতে পারে। রাত সাড়ে ১০টায় এ প্রতিবেদন তৈরি পর্যন্ত এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। অন্যদিকে বড়হাটের জঙ্গি আস্তানা বাড়িটি ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সোয়াতের এ অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন হিট-ব্যাক’। মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাটে জঙ্গিদের আস্তানা থাকার বিষয়ে পুলিশের কাছে গোপন তথ্য ছিল। সে অনুযায়ী টানা তিন দিন রেকি করে ওই এলাকার একটি বাড়িতে আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টা থেকে বাড়িটি ঘিরে ফেলেন পুলিশ সদস্যরা। ওই সময় বড়হাটের বাড়ির মালিকের নাসিরপুরের আরেকটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা থাকার খবর পায় পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে ওই বাড়িটিও ঘিরে ফেলা হয়। ভোরের দিকে দুই বাড়িতেই বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সারা দিন একাধিকবার গুলির শব্দ শোনা গেছে। বিকাল পৌনে ৫টায় অভিযানে ঢাকা থেকে এসে যোগ দেয় সোয়াতের একটি দল। সন্ধ্যা ৬টার কিছুক্ষণ পর নাসিরপুরে ‘অপারেশন হিট-ব্যাক’ শুরু করে তারা। বৃষ্টির মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিট থেকে ৭টা ২০ মিনিট পর্যন্ত টানা এক ঘণ্টা প্রচণ্ড গোলাগুলি হয় জঙ্গিদের এ আস্তানায়। গোলাগুলি থামার পর বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করতে দেখা যায়। তবে অভিযান শেষ হয়েছে কি না এ ব্যাপারে অভিযানকারীদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, অপর জঙ্গি আস্তানা বড়হাটে অভিযান শেষ হওয়ার পর এ ব্যাপারে প্রেস ব্রিফিং করা হতে পারে। এদিকে নাসিরপুরে সোয়াত সদস্যদের অভিযানে কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা গেছে। একটি অসমর্থিত সূত্র জানিয়েছে, প্রাণহানির সংখ্যা ছয় হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সে জন্য প্রাণহানির এ সংখ্যা নিশ্চিত নয়। এদিকে রাত সাড়ে ১০টায় সিলেট জোনের ডিআইজি কামরুল আহসান জানান, অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। মৌলভীবাজার পৌর শহরে বড়হাট এলাকার অপর আস্তানার অভিযান শেষ হলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তারিত জানিয়ে দেওয়া হবে। দুই আস্তানায় একাধিক জঙ্গি : সূত্র জানিয়েছে, বড়হাট ও নাসিরপুরের দুই আস্তানায় অন্তত দশের অধিক জঙ্গি রয়েছে। এর মধ্যে নাসিরপুরে ছয়জন ও বড়হাটে চার জঙ্গি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। দ্রুত সরানো হয় আশপাশের বাসিন্দাদের : দুটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে গতকাল সকাল থেকেই আশপাশের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করে প্রশাসন। গাড়ি দিয়ে এলাকায় মাইকিং করে সবাইকে জঙ্গি আস্তানা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে আহ্বান জানানো হয়। থেমে থেমে গুলি-বিস্ফোরণ : বড়হাট ও নাসিরপুরে দুটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানায় থেমে থেমে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টা থেকে বাড়ি দুটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘেরাও করে রাখার পর ভোর থেকে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ওই সময় বড়হাট ও নাসিরপুরে দুটি করে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। তবে পুলিশ, নাকি জঙ্গিদের পক্ষ থেকে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, তা এ তা নিশ্চিত করেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ। সকাল ১০টা পর্যন্ত থেমে থেমে চলে গুলি। এরপর কিছু সময় শান্ত থাকার পর বেলা ১২টা ৪০ ও ১২টা ৪৫ মিনিটে গুলির শব্দ শোনা যায়। বড়হাটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লক্ষ্য করে তিনটি বোমা ছোড়া হয়, যার দুটি বিস্ফোরিত হয়। অন্যদিকে নাসিরপুরে দুটি বোমা নিক্ষেপ করার পর সেগুলো বিস্ফোরিত হয়। সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিট থেকে ৭টা ২০ মিনিট পর্যন্ত টানা এক ঘণ্টা নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় গোলাগুলি হয়। দুই কিলোমিটার এলাকায় ১৪৪ ধারা : দুটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা পুলিশ ঘিরে রাখার পর বেলা ১২টার কিছুক্ষণ পর মৌলভীবাজার পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড, পার্শ্ববর্তী কুসুমবাগ এলাকা ও খলিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে দুই কিলোমিটার এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

ঘটনাস্থলে সোয়াত : ঢাকা থেকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা দুপুরে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। পরে দুই জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের জন্য ঢাকা থেকে বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াতের সদস্যরা বিকাল পৌনে ৫টায় ঘটনাস্থলে আসেন। সোয়াত সদস্যরা আসার পর বিকাল ৫টায় নাসিরপুরে একটি গুলির শব্দ শোনা যায়।

গোলাগুলিতে ঘুম ভাঙে : বড়হাট ও নাসিরপুর এলাকার মানুষ যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখন গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভাঙে তাদের। গতকাল ভোররাতে বড়হাট ও নাসিরপুরে গোলাগুলির শব্দে ঘুম থেকে জেগে জঙ্গি আস্তানার বিষয়টি জানতে পারেন স্থানীয়রা। খলিলপুর ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান হাজি ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘গোলাগুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙে। পরে জানতে পারি জঙ্গি আস্তানা ঘিরে গোলাগুলি চলছে।’

দুই বাড়ির মালিক এক প্রবাসী : মৌলভীবাজারের বড়হাট ও খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুর গ্রামের যে দুটি বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে জঙ্গিরা, এ বাড়ি দুটির মালিক সাইফুল ইসলাম যুক্তরাজ্য প্রবাসী। মাঝেমধ্যে দেশে এলে তিনি বড়হাটের বাড়িতে থাকেন, বেড়াতে যান নাসিরপুরের বাগানবাড়িতে। সাইফুল যুক্তরাজ্যে ট্যাক্সিচালক হিসেবে কাজ করেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সাইফুলের অবর্তমানে বাড়ি দুটি দেখাশোনা করেন তার মামাতো বোনের স্বামী জুয়েল আহমদ। বড়হাটের বাড়িটি ডুপ্লেক্স ধরনের আর নাসিরপুরের বাড়িটি একতলা টিনশেডের।

যেভাবে বাড়ি ভাড়া নেয় জঙ্গিরা : জানুয়ারি মাসে বড়হাট এলাকার বাড়িটি জনৈক বেলাল আহমদ পরিচয়ধারী এক ব্যক্তি ভাড়া নেন। তিনি নিজেকে একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বাড়িটি ভাড়া নেন। বেলালের সঙ্গে তার স্ত্রী ও শ্যালক ওই বাড়িতে থাকতেন। বাড়ির কেয়ারটেকার জুয়েল আহমদ জানান, মাসিক সাত হাজার ৬০০ টাকা ভাড়ার ভিত্তিতে বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন বেলাল।

প্রায় আড়াই মাস আগে বেলাল নাসিরপুরের বাড়িটিও ভাড়া নেওয়ার কথা বলেন কেয়ারটেকার জুয়েলকে। নাসিরপুরের বাড়িতে নিজের আত্মীয় বলে পরিচয় দেওয়া মাহফুজ আহমদ নামের এক ব্যক্তি থাকার কথা জানান বেলাল। ওই বাড়িতে মাহফুজ তার চার ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী ও শ্বশুর-শাশুড়িদের নিয়ে বসবাস করেন।

কুমিল্লা থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধি জানান, কুমিল্লা সিটির কোটবাড়ী এলাকার দক্ষিণ বাঘমারা গ্রামে এক বাড়িতে জঙ্গিদের আস্তানার খবর পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জঙ্গিদের অবস্থান সন্দেহে বাড়িটি ঘিরে রেখেছে তারা। এ ঘটনায় বাড়ির মালিকের ছোট ভাই সাদ্দাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ। আজ ভোটের পর অভিযান চালানো হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার সোয়াত টিমসহ একটি টিম কুমিল্লায় আসছে। রাতে চট্টগ্রাম থেকেও সোয়াতের একটি টিম ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট সেখানে পৌঁছার কথা। জানা গেছে, কোটবাড়ী এলাকা সিটির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে। এই বাড়ির নিকট গন্ধমতী হাই স্কুল কেন্দ্রে আজ ভোট। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগের দিন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির মধ্যেই এই জঙ্গি আস্তানার খবর পেল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে ভোট শেষে অভিযান চালানোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। তিনি বলেন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা হয়েছে। ভোটাররা কোনোভাবেই আতঙ্কিত হবেন না। ভোটের কোনো অসুবিধা হবে না। পুলিশ জানিয়েছে— প্রয়োজন হলেই অভিযানের বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। তবে ভোটের মধ্যে এ অভিযান হবে না। প্রয়োজনে ভোট শেষে তারা অভিযান চালাবে। কুমিল্লার পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন জানান, গতকাল দুপুরে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা কোটবাড়ী সংলগ্ন দক্ষিণ বাগমারা বড় কবরস্থানের পাশে তিন তলা ওই বাড়ি ঘিরে ফেলে। জানা গেছে, এই বাড়ির মালিক দেলোয়ার হোসেন সৌদি আরবে ছিলেন। এখন দেশে এসে পিকআপ ভ্যান চালান। তার তিন তলা বাড়িটি নির্মাণাধীন। নিচ তলায় ভাড়া নিয়ে থাকেন সন্দেহভাজন জঙ্গিরা। এ ঘটনার পরে গণমাধ্যম কর্মীরা ছুটে গেলে বাড়িটির কাছে তাদের যেতে নিষেধ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাড়ির আশপাশ ঘিরে রেখেছে তারা। জঙ্গি আস্তানার খবরে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ে বাড়ির মালিক দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রায় দেড় মাস আগে গেঞ্জি ব্যবসায়ী পরিচয়ে দুই যুবক বাড়িটির নিচ তলা ভাড়া নেয়। তাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলা বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু তাদের কোনো পরিচয়পত্র জমা দেননি। পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ওই বাড়িতে কয়েকজন জঙ্গি আছে এবং তাদের কাছে বোমা থাকতে পারে।

সর্বশেষ খবর