বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

নৌকা না ধানের শীষ

মাহমুদ আজহার, গোলাম রাব্বানী ও মহিউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা থেকে

নৌকা না ধানের শীষ

অবশেষে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে ভোট উৎসব আজ। দৃষ্টি সবার আজ কুমিল্লায়। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে। নির্বাচন  ঘিরে নগরজুড়েই চলছে উৎসবের আমেজ। অপেক্ষায় ভোটাররা। এ নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চারজন। তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রধান দুই দলের দুই প্রতীক নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থী। আওয়ামী লীগের আঞ্জুম সুলতানা সীমা, না বিএনপির মনিরুল হক সাক্কু— তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। তবে নগরপিতা যিনিই হোন, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কথাই বলছেন নগরবাসী। এটিকে দুই দলেরই মর্যাদার লড়াই হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। এদিকে সিটির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ বাগমারায় এক বাড়িতে জঙ্গিদের অবস্থান সন্দেহে বাড়িটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘিরে রেখেছে। এ নিয়ে ওই এলাকার ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নতুন নির্বাচন কমিশনের অগ্নিপরীক্ষা আজ। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থা ও গণমাধ্যমকর্মীরা। এরই মধ্যে ভোট গ্রহণের সব প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন (্ইসি)। বিশেষ নিরাপত্তায় ভোট কেন্দ্রে ব্যালটসহ নির্বাচনী মালামাল পাাঠানো হয়েছে। প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। ভোট গ্রহণ ও ভোটারদের নিরাপত্তায় মাঠে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ৫ হাজার সদস্য। সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে এসব বাহিনীকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইসি। নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে চার স্তরের নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে রয়েছেন বিজিবি-র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা। কেউ কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে বিজয়ের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘উন্নয়নের কথা ভেবে জনগণ জননেত্রী শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে নৌকা প্রতীকে ভোট দেবেন। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হবে জেনে দলের নেতারা মিথ্যাচার শুরু করেছেন। বিএনপি-জামায়াতের মদদে জঙ্গিরা দেশজুড়ে আত্মঘাতী বোমা হামলা ও নাশকতা চালাচ্ছে। মানুষ উন্নয়ন চায়, শান্তি চায়। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ চায় না। তাই আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সর্বস্তরের মানুষ সৎ, যোগ্য প্রার্থী সীমাকে ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর প্রধান সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমাদের প্রার্থী (সাক্কু) অভিজ্ঞ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। ভোট সুষ্ঠু হলে তিনি জয়ী হবেন। বিএনপির জনপ্রিয়তার প্রমাণ হবে। তবে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ হয়রানি করছে।’

নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেছে। ভোটারদের আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রেও থাকছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা। ভোটাধিকার প্রয়োগে কোনো ভোটারকে কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার পথে কেউ বাধা দিলে বা ভয়ভীতি, শক্তি প্রদর্শন করলে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ভোট উপলক্ষে এই সিটিতে আজ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। মেয়র পদে নির্বাচনী লড়াইয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদ ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এরা হলেন আওয়ামী লীগের আঞ্জুম সুলতানা সীমা, বিএনপির মনিরুল হক সাক্কু, জেএসডির শিরিন আকতার ও স্বতন্ত্র মেজর মামুনুর রশিদ (অব.)। এ ছাড়া সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৪০ ও সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১১৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন।

শেষ মুহূর্তে কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগও উঠেছে কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে। বিত্তশালী প্রার্থীরা ভোট কিনতে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ধরনা দিচ্ছেন। নগদ অর্থ ছাড়াও ভোটারদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে শাড়ি, লুঙ্গি, টিশার্ট, থ্রিপিসসহ বিভিন্ন উপহারসামগ্রী।

এক নজরে কুমিল্লা সিটি : ওয়ার্ড ২৭টি। মোট ভোটার ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬ জন। পুরুষ ১ লাখ ২ হাজার ৪৪৭, মহিলা ১ লাখ ৫ হাজার ১১৯ জন। কেন্দ্র ১০৩। ভোটকক্ষ ৬২৮। ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ১ হাজার ৯৮৭ জন।

কেন্দ্রে কেন্দ্রে মালামাল : প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কাছে গতকাল সকালে নির্বাচনী মালামাল তুলে দিয়েছেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা। গতকাল বিকালের মধ্যে এসব মালামাল নিরাপদে কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা।

ইসির নিজস্ব পর্যবেক্ষক : নির্বাচনী মাঠে নামছেন ইসির ২৭ জন ‘নীরব পর্যবেক্ষক’। ইসির নিজস্ব এসব কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রেখে নির্বাচনের সামগ্রিক পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য ইসিকে জানাবেন। ইসির কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে এসব পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। কোথাও অনিয়মের খবর পেলে তারা কমিশনকে জানাবেন এবং সেই তথ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে ইসি।

যান চলাচলে কড়াকড়ি : নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনী এলাকায় চার দিনের জন্য মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে ভোটের পরদিন শুক্রবার ভোর ৬টা পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে। এ ছাড়া গতকাল মধ্যরাত থেকে আজ বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত অটোরিকশা, ইজিবাইক, টেম্পো, ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস ও ট্রাক চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে নির্বাচনী এলাকায়। জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহনের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।

ব্যালটে অবৈধ হাত দিলে প্রতিরোধ : কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল। গতকাল কুমিল্লা পুলিশ লাইনসে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ব্যালটে অবৈধ হাত দিলে তা প্রতিহত করা হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। রকিব উদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। কোনো অনিয়ম হবে না। কেউ অনিয়ম করতে চাইলে সাবধান হয়ে যান। আমাদের হাত অনেক শক্ত। যে কোনো বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে যে হাতিয়ার প্রয়োজন তা-ই ব্যবহার করব। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। কোনো অনিয়ম হবে না। কারও অনিয়ম করার ইচ্ছা থাকলে সাবধান হয়ে যান।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে “সুন্দর নির্বাচন’ করতে চায় কমিশন। কিন্তু অনেক সময় চাইলেও তা পারা যায় না। অনিয়মের কারণে কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখতে হয়। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এবারের নির্বাচনে কোনো কারচুপি হবে না। ?সুন্দর নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পোলিং এজেন্ট, রাজনৈতিক দল, সর্বোপরি ভোটার— সবার সমর্থন চাই।’ নির্বাচনে যার যা দায়িত্ব তা সুন্দরভাবে পালনের আহ্বান জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা।

‘জিরো টলারেন্স’ নীতি : কুমিল্লার পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন বলেন, ‘যে কোনো ধরনের অনিয়ম, সহিংসতা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি দেখানো হবে। কেউ কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে আমরা সেখান থেকে তাকে স্বাভাবিকভাবে যেতে দেব না। বিশৃঙ্খলা করলে কেউ অক্ষত অবস্থায় পুলিশের সামনে থেকে যেতে পারবে না।’ নির্বাচন কমিশনের ‘যে কোনো বৈধ আদেশ’ পুলিশ সদস্যরা পেশাদারির সঙ্গে পালন করবে বলেও মন্তব্য করেন পুলিশ সুপার। সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য ভোট গ্রহণ শুরুর আগে ম্যাজিস্ট্রেট, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের মোবাইল ফোন নম্বর পুলিশ সদস্যদের সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেন তিনি। ‘এবার প্রতিটি কেন্দ্রের ইনচার্জের হাতে আমরা একটি করে ওয়াকিটকি দিয়ে দেব, যাতে যোগাযোগ সহজভাবে করা যায়।’

সুষ্ঠু নির্বাচনে কাজ করবে আনসার : নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে কাজ করবে আনসার। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপমহাপরিচালক (অপারেশন) দীলিপ কুমার এসব কথা বলেন। সম্মেলনে রিটার্নিং অফিসার রকিব উদ্দিন মণ্ডল, কুমিল্লার রেঞ্জ পরিচালক হীরা পারভেজ, উপপরিচালক সৈয়দ ইফতেহার আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। দীলিপ কুমার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী এ নির্বাচনে আমাদের ১ হাজার ৯৭২ জন সদস্য কাজ করবেন। এর মধ্যে ৫০০ জন কাজ করবেন স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে। এ ছাড়া চৌকস সদস্যরাও ভোটের দায়িত্ব পালন করবেন।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর