শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

মৌলভীবাজার অভিযানে নিহত ৮

দুই ঘরজুড়ে ছিন্নভিন্ন লাশ

শাহ্ দিদার আলম নবেল ও সৈয়দ বয়তুল আলী, মৌলভীবাজার থেকে

মৌলভীবাজার অভিযানে নিহত ৮

নাসিরপুরে জঙ্গি আস্তানা ঘিরে গতকালও ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থান —বাংলাদেশ প্রতিদিন

মৌলভীবাজারের খলিলপুর ইউনিয়নের নাসিরপুর গ্রামে টিনশেড একতলা একটি বাড়ি। যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাইফুর রহমানের মালিকানাধীন বাগানবাড়িটি ঘিরে দুই দিন ধরে চলছিল রুদ্ধশ্বাস অভিযান ‘অপারেশন হিটব্যাক’। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে চলা পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াত সদস্যদের সে অভিযান শেষ হয়েছে। অভিযানে এক জঙ্গি পরিবারের সব সদস্যই ‘আত্মহনন’ করেছেন। সে সংখ্যা হতে পারে ৭ বা ৮। সোয়াত সদস্যদের অভিযানের শুরুতেই তারা ‘বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহনন’ করেন। এদিকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের আরএমও জানান, নিহতদের মধ্যে একজন পুরুষ, দুইজন নারী ও চার শিশু রয়েছে। মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাটের জঙ্গি আস্তানায় সোয়াত সদস্যরা গতকাল অভিযান চালাননি। এ আস্তানায় আজ সূর্যোদয়ের পর থেকেই অভিযান শুরু হতে পারে। তিন দিন রেকি করে মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাটে জঙ্গি আস্তানার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টায় ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই সময় জেলার নাসিরপুরে আরেক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পান তারা। সে আস্তানাও ঘিরে ফেলা হয়। বুধবার ভোরে উভয় আস্তানা থেকে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ওই দিন বিকালে নাসিরপুরে অভিযান চালাতে ঢাকা থেকে আসে সোয়াতের একটি দল। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন হিটব্যাক’। অভিযানের শুরুতেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নাসিরপুরের বাড়ির আস্তানায় সপরিবারে জঙ্গিরা ‘আত্মহনন’ করে বলে প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। খলিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘নাসিরপুরে অভিযান শেষে আমরা ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে পাই, বাংলো ধাঁচের বাগানঘেরা টিনশেড একতলা বাড়ির প্রবেশপথসহ বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু আইইডি (রূপান্তরিত বিস্ফোরক) ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। সেসব সরিয়ে, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিষ্ক্রিয় করার পর বাড়িতে ঢোকা সম্ভব হয়। আমরা ভিতরে যে বীভৎস চিত্র দেখেছি, বিভিন্ন জায়গায় মানুষের দেহের বিভিন্ন অংশ ছড়ানো। সেই চিত্র ধারণ করতে পারলেও আপনারা প্রচার করতে পারবেন না, এতটাই বীভৎস। লাশের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে, বাড়ির বাসিন্দাদের মৃত্যু শক্তিশালী বিস্ফোরণে হয়েছে। মৃতদেহ থেকে তীব্র গন্ধ বের হওয়ায় আমাদের ধারণা, বুধবার অভিযানের শুরুতেই তারা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।’ মনিরুল বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, সোয়াত যখন অভিযান শুরু করে, তারা (জঙ্গিরা) দেখে যে পালানোর পথ নেই, তখনই সম্ভবত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সপরিবারে আত্মহনন করেছে। কোনো মৃতদেহ আসলে অক্ষত নেই। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে দুটো কক্ষজুড়ে ছড়িয়ে আছে। সেগুলোর মাথা, পা একেকটা একেক জায়গায়। সেগুলো মিলিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, সাত-আটটি মৃতদেহের অংশবিশেষ হতে পারে। নিহতদের মধ্যে কজন পুরুষ ও কজন নারী, তা বলা যাচ্ছে না। পুরুষ, নারী ও দু-একজন অপরিণত বয়সীর মৃতদেহ রয়েছে।’ ব্রিফিংয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সূত্র ধরে অনুসন্ধান করছিলাম বলে নিশ্চিত হয়েই বলতে পারি, বাড়িটিতে নব্য জেএমবির সদস্যরাই আত্মগোপন করেছিল।’ নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানার বাড়িতে গতকাল ড্রোন ব্যবহার করা হয় জানিয়ে মনিরুল বলেন, ‘ঢাকা থেকে ড্রোন এনে বাড়িটির ভিতরের ছবি তোলা হয়। ছবি দেখে প্রবেশদ্বারসহ স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে যেসব বোমা ও গ্রেনেড জঙ্গিরা রেখেছিল, সেগুলো নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়।’ তিনি বলেন, সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে যে ধরনের আইইডি (রূপান্তরিত বিস্ফোরক) পাওয়া গিয়েছিল, নাসিরপুরের বিস্ফোরকগুলোও একই রকম। নাসিরপুরে যেসব অবিস্ফোরিত বোমা পাওয়া গেছে, সেগুলোর সঙ্গে ঢাকায় বিমানবন্দরের বাইরের ঘটনায় পাওয়া বোমার মিল রয়েছে। সিলেটের আতিয়া মহলে নিহত চার জঙ্গি এবং নাসিরপুরে নিহত জঙ্গিদের সবাই নব্য জেএমবির সদস্য। গতকাল প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এমনটাই বলেন মনিরুল ইসলাম। বড়হাট ও নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানার বাইরে মৌলভীবাজারে অন্য কোনো আস্তানার ব্যাপারে পুলিশের কাছে তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।

খোঁজ নেওয়া হবে তত্ত্বাবধায়ক সম্পর্কে : বড়হাট ও নাসিরপুরের বাড়ি দুটির তত্ত্বাবধায়ক যিনি, সেই জুয়েল আহমদ সম্পর্কে তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন সিটিটিসির প্রধান মনিরুল। জঙ্গিদের সঙ্গে বাড়ি দুটির তত্ত্বাবধায়কের আদর্শগত কোনো মিল আছে কি না, প্রেস ব্রিফিংয়ে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে তা বলা যাচ্ছে না। এটি তদন্ত সাপেক্ষে দেখা হবে।’

সূর্যোদয়ের পর বড়হাটে অভিযান : মৌলভীবাজারের অপর জঙ্গি আস্তানা বড়হাটে আজ সূর্যোদয়ের পর অভিযান শুরু হতে পারে জানিয়েছেন সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সম্ভব হলে (বৃহস্পতিবার) রাতে অভিযান হতে পারে। অন্যথায় শুক্রবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই চালানো হবে অভিযান। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অভিযান চালানো হবে।’

মানুষের মধ্যে আতঙ্ক : মৌলভীবাজারের দুই জঙ্গি আস্তানা ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গতকাল বেশ কয়েকজন স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন। নিজেদের এলাকায় এ রকম জঙ্গি আস্তানা থাকার বিষয়টি তারা ভাবতেই পারেননি।

সিলেটে দুই জঙ্গির লাশে পচন : আতিয়া মহলে সেনা কমান্ডোদের অভিযান শেষ হয়েছে মঙ্গলবার। তবে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী পাঠানপাড়ায় পাঁচ তলা ভবনের ভিতর রয়েগেছে দুই জঙ্গির লাশ। সেই লাশ পচে এখন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আতিয়া মহলের ভিতরের বিস্ফোরক গতকালও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে নিহত জঙ্গিদের মধ্যে নব্য জেএমবি নেতা মাঈনুল ইসলাম মুসা রয়েছেন কিনা, তা জানতে তার মায়ের ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া শিববাড়ী এলাকার ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বোমা হামলায় ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় কোনো আটক নেই। মামলা হয়নি আতিয়া মহলের ঘটনায়। মঙ্গলবার রাতে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ঢাকা থেকে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট এসে আতিয়া মহলকে বিস্ফোরকমুক্ত করবে। তবে জানা গেছে, এরপর দুই দিন পেরিয়ে গেলেও বিস্ফোরকমুক্ত হয়নি আতিয়া মহল। ভিতরে পড়ে আছে দুই জঙ্গির লাশও। গতকাল সরেজমিনে শিববাড়ী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আতিয়া মহলে থাকা দুই জঙ্গির লাশ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। প্রায় পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গন্ধ। দ্রুত লাশ দুটি উদ্ধার না করলে দুর্গন্ধে এলাকায় টিকে থাকা দায় হবে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার জেদান আল মুসা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের একটি দল গতকাল আতিয়া মহল পর্যবেক্ষণ করে গেছে। তারা শিগগিরই ভবনটি বিস্ফোরকমুক্ত করার কাজ শুরু করবে। বিস্ফোরক সরিয়ে না নিলে লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হবে না।’

ডিএনএ টেস্ট : সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী পাঠানপাড়ায় আতিয়া মহলে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত চার জঙ্গির একজন নব্য জেএমবির নেতা মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা কিনা, তা জানতে তার মায়ের ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। গতকাল বিকাল ৩টার দিকে মুসার মা সুফিয়া বেগমের ডিএনএ’র নমুনা ওসমানী হাসপাতালে সংগ্রহ করা হয়। এর আগে দুপুরে মেয়ে কামরুন নাহারকে নিয়ে সিলেট পৌঁছেন সুফিয়া বেগম। বুধবার রাজশাহী থেকে তাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সিলেট মহানগরীর কোতোয়ালি থানার ওসি সোহেল আহমদ বলেন, ‘আতিয়া মহলে নিহত চার জঙ্গির একজন নব্য জেএমবির নেতা মুসা বলে আমরা ধারণা করছি। তার লাশ দেখে পরিচয় শনাক্ত করা কঠিন। এজন্য মুসার মা সুফিয়া বেগমের ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।’

আটক নেই, হয়নি মামলা : বোমা হামলায় ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় গত রাত ৮টা পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। এ ছাড়া আতিয়া মহলের ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি। মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার জেদান আল মুসা বলেন, ‘বোমা হামলার ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি। তবে তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। তদন্তের স্বার্থেই তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। আতিয়া মহলের ঘটনায় মামলা করা হয়নি।’

বোমাসদৃশ বস্তু ঘিরে আতঙ্ক : সিলেট নগরীর শাহি ঈদগাহে একটি দোকানের সামনে বোমাসদৃশ বস্তু ঘিরে গতকাল আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দোকানের মালিক মহানগরীর ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনাম আহমদ সকালে দোকান খুলতে এসে কালো স্কচটেপে মোড়ানো বস্তুটি দেখতে পেয়ে পুলিশে জানান। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। পরে সেনাবাহিনীর বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের একটি দল ঘটনাস্থলে এসে বস্তুটি বোমা নয় বলে নিশ্চিত করে। মহানগর পুলিশের উপকমিশনার ফয়সাল মাহমুদ জানান, সেটি ফলস ককটেল ছিল, যা ফাটলে বিকট শব্দ হয়। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট সেটি নিষ্ক্রিয় করেছে।

সর্বশেষ খবর