শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগ হারল যে কারণে

রফিকুল ইসলাম রনি

আওয়ামী লীগ হারল যে কারণে

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার পরাজয়ের কারণ কী?— বিশ্লেষণে বসেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। হিসাব-নিকাশের খাতা বড় কঠিন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নানামুখী বিশ্লেষণ। একদিকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কুমিল্লা আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়নি। অন্যদিকে নির্বাচনের দিন কর্মীদের মাঠে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সমন্বিত প্রচেষ্টা ছিল না। অবস্থাটাকে অভ্যন্তরীণ কোন্দল হিসেবেই দেখছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতার নামে নৌকার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈরী আচরণ করেছেন বলেও অভিযোগ করেন তারা।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের অবস্থা ভালো ছিল না। প্রথমেই অবস্থার উত্তরণে কাজ শুরু করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম। এরপর দলের সিনিয়র নেতা প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহর নেতৃত্বে আলাউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী নাসিম থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকনসহ আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা সেখানে টানা অবস্থান নেন। কিন্তু কোন্দল মেটেনি। অন্যদিকে প্রশাসন ছিল দ্বিমুখী তত্পরতায়। নির্বাচনের দিন কুমিল্লার একজন মন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে বলেছিলেন পুলিশ সদরের দক্ষিণে ৯টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন কেন্দ্রে নৌকার ব্যাজ লাগানো নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অহেতুক ঝামেলা করছে। এমনকি তাদের পেটাচ্ছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট ছিল যা নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনেও দেখা যায়নি। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে কুমিল্লার পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগের ভুল বোঝাবুঝি। নির্বাচন চলাকালে কুমিল্লার একটি উপজেলার নারী কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর অ্যাকশনমুখী ছিলেন বলে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ। যেখানেই আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, সেখানেই কঠোর অবস্থানে গিয়েছেন ওই নারী কর্মকর্তা। এর বাইরে নির্বাচনের আগের রাতে দলের তেমন একটা ঐক্য প্রয়াস দেখা যায়নি। ভোটের দিন সমন্বয়ের অভাব ছিল। অনেক এলাকায় পোলিং এজেন্টদের হাত খরচ ঠিকমতো দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে চলছে পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা। কার খরচ দেওয়ার কথা ছিল, কে দেয়নি এসব নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর পক্ষে নেতা-কর্মীরা ছিলেন ঐক্যবদ্ধ। ছোটখাটো বিরোধ থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত প্রভাব ফেলতে পারেনি। যার ফলে তিনি সহজেই নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মনিরুল হক সাক্কু ১১ হাজার ৮৫ ভোট বেশি পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। সাক্কু পেয়েছেন ৬৮ হাজার ৯৪৮ ভোট আর আওয়ামী লীগ মনোনীত সীমা পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৮৬৩ ভোট।  কুমিল্লার স্থানীয় নেতারা বলছেন, দলীয় প্রার্থী স্বচ্ছ ইমেজের হলেও তার পিতা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা প্রবীণ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট আফজল খান ও বাহার উদ্দীনের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণেই কুমিল্লায় ক্ষমতাসীন দলকে হারতে হয়েছে। আফজল-বাহার দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে তারা জানান, কুমিল্লায় নৌকার ভোট বেশি হলেও দ্বন্দ্ব্ব-কোন্দল যতদিন শেষ হবে না, ততদিন নৌকাকে এভাবে হারতে হবে, তা আবারও প্রমাণিত হলো। ভোটের দিন বাহার উদ্দীনের কর্মকাণ্ড নিয়ে স্থানীয় নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন। ভোট দিয়ে বাইরে এসে গণমাধ্যমের সামনে তা ফলাও করে প্রচার করাটাকেও সন্দেহের চোখে দেখছেন তারা। তাদের মতে, বাহার উদ্দীন নৌকার লোক। তিনি নৌকাতেই ভোট দেবেন। কিন্তু এটা জানানোর কী আছে! আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, কুমিল্লায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই তারা নির্বাচনী ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। এ পরাজয়কে সতর্ক বার্তা হিসেবে নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে পরাজয়ের পরে সারা দেশে এ ধরনের বিরোধ মেটাতে জোর উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সতর্ক করার পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন— এখনই এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে না পারলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় মাশুল দিতে হবে। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়নি বলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে—এটা স্বীকার করে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কুমিল্লায় দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারিনি। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়েছিল। তিনি বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল নিরপেক্ষ, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা। জয়-পরাজয় বিষয় জনগণের। গতকাল গাজীপুরে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করেন। কুমিল্লা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান সমন্বয় ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নৌকার পরাজয়ের পেছনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই কাজ করেছে। আমাদের দলের কাউন্সিলররা নৌকার বিপক্ষে ছিলেন। সদর আসনের এমপি বাহার উদ্দীন বাহারও বিরোধিতা করেছেন। তাহলে আমরা কীভাবে জিতব! তিনি বলেন, ১১ মার্চ পর্যন্ত কুমিল্লায় নৌকার কোনো অবস্থান ছিল না। আমরা কেন্দ্রীয় নেতারা দৌড়ঝাঁপ করে অবস্থার পরিবর্তন করেছিলাম। বাহার যদি আমাদের সহযোগিতা করতেন, তাহলে আমরা ভালোভাবে জিততে পারতাম। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিটি নির্বাচনে কেন্দ্রীয় টিমের সদস্য সচিব একেএম এনামুল হক শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছিল। এর পাশাপাশি প্রশাসন নিরপেক্ষতার নামে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-ভোটারদের সঙ্গে বৈরী আচরণ করেছে। সে কারণে নৌকার পরাজয় হয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতাদের ভুল বার্তা দিয়েছিলেন স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা। তিনি বলেছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের ভোট নিয়ে দেবেন, আমাদের সেখানে নজর না দিলেও চলবে। সেখানে আমরা বড় ব্যবধানে পাস করব। কিন্তু আমরা সেখানে ৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলাম। নৌকার পরাজয়ের মূল কারণ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। তিনি অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তথাকথিত নিরপেক্ষতা প্রমাণের নামে নৌকা ব্যাজ লাগানো নেতা-কর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছে। নাজেহাল করেছে। এদিকে গতকাল রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘দলের মধ্যে শৃঙ্খলা রাখতে হবে। দলের মধ্যে ব্যক্তি স্বার্থ, ব্যক্তি লোভ কাজ করবে এটা মেনে নেওয়া হবে না। স্থানীয় নির্বাচনে অনেক সময় গ্রুপিং, দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়ে। যার প্রমাণ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যারা কাজ করেছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, কুমিল্লার বিষয়ে ইতিমধ্যে সাংগঠনিক সম্পাদকদের তথ্য নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। এরপর সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর