রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সহযোগিতা বাড়াতে সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে গোলটেবিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

সহযোগিতা বাড়াতে সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতার সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন রাজনীতিবিদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীসহ বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞরা। গতকাল রাজধানীর লেকশোর হোটেলে ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (আইক্ল্যাডস) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা’ শিরোনামে আয়োজিত এ গোলটেবিল আলোচনায় তারা এ আহ্বান জানান। এক্ষেত্রে তারা তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে তা কার্যকর করা, শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরও ভারতের আরোপিত অশুল্ক বাধা দূর করে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পথ তৈরি করা এবং সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ এপ্রিল ভারত সফরে এসব বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে দেশটির সঙ্গে চলমান সুসম্পর্ক আরও বাড়ানোর কথা বলেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা রয়েছে। তাই নতুন করে প্রতিরক্ষা বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের বদলে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করা যেতে পারে। 

সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ক্ষেত্রে হলো পানির সুষম বণ্টন, বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা নিশ্চিত করা এবং সীমান্তে হত্যা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে এসব বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। ভারতের উচিত বাংলাদেশকে সন্তুষ্ট করা। আর প্রতিরক্ষা বিষয়ে চুক্তি হবে, নাকি এমওইউ হবে— তা পরিষ্কার করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার অনেক সমস্যা সমাধান হয়েছে। যেমন ছিটমহল সমস্যা। আশা করছি, তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এর চেয়ারম্যান মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক কখনো চুক্তির ওপর নির্ভর করে না। প্রতিরক্ষা বিষয়ে চুক্তি বা স্মারক, যা-ই স্বাক্ষর হোক না কেন, তা যদি তৃতীয় কোনো দেশের বিপক্ষে না যায় এবং নিজেদের সার্বভৌম রক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা না হয়, তাহলে ক্ষতির কিছু নেই। আইক্ল্যাডসের নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ বলেন, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা চুক্তির বাস্তবায়ন হলেও সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশের মানুষকে পীড়িত করে। এটি শূন্যে নামিয়ে আনার চ্যালেঞ্জটা ভারতকেই নিতে হবে। আর প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অবয়ব আমরা জানি না। তবে সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা খর্বের শর্ত না থাকলে এবং সামরিক জোটের ক্ষেত্র বাদ দিয়ে সামরিক সহযোগিতা হতে কোনো বাধা নেই।

পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমাদ বলেন, আমরা শুধু তিস্তা নিয়ে বসে আছি, আরও অনেক নদীতে বাঁধ হয়ে গেছে, পানি আসছে না। আমরাও গঙ্গা ব্যারাজ দিতে পারি। ভারত আগে আপত্তি করেছে। যদিও তাদের আপত্তির কোনো কারণ নেই। গঙ্গা ব্যারাজ হলে তাদের ওখানে পানি আটকে যাবে, তা নয়। সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে। তার আওতায় আমরা চীন থেকে অস্ত্র কিনছি, তার গুণগত মান যেমনই হোক না কেন। ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে সমস্যা কী? সংসদ সদস্য মইনুদ্দীন খান বাদল বলেন, ভারতের মনে রাখতে হবে আমরা কৃতজ্ঞ জাতি কিন্তু জাত্যাভিমান আছে। স্বাধীনতার জন্য ভারতের ত্যাগ আছে, কিন্তু বাংলাদেশও অনেক কিছু দিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন অর রশীদ বলেন, ভারতের সঙ্গে অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে, প্রত্যাশাও অনেক আছে। তিস্তা চুক্তি এখনো হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু  সেখানে অন্য ধর্মের মানুষদের নিয়ে যে কটাক্ষ হচ্ছে, তার প্রভাব বাংলাদেশের উপরও পড়ছে। এটা বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নও বাধাগ্রস্ত করছে। সীমান্তে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চলছে, ভিসা পেতে এখনো সমস্যা রয়েছে। তিস্তা চুক্তির মমতার ইচ্ছার ওপর আটকে রয়েছে। এখানে কোনো প্রাপ্তি হবে মনে হচ্ছে না। পাঁচ লাখ ভারতীয় বাংলাদেশের বস্ত্রখাতে চাকরি করছে, সে তুলনায় আমরা ভারতে চাকরি করতে পারছি কি-না? শোলাকিয়া ঈদগাহ্ এর ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, বাংলাদেশ-ভারত কিছু করতে গেলেই হিন্দু-মুসলিম হিসেবে তা দেখা হয়। যখন দুই দেশের সম্পর্কে ধর্ম প্রাধান্য পায়, তখন পুরো বিষয়টি আরও জটিলতর হয়। কিছু মানুষ বাংলাদেশ-ভারতকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে না ভেবে ধর্ম হিসেবে ভাবে। ইশফাক ইলাহী বলেন, বাংলাদেশ-ভারত কিছু ক্ষেত্রে সামরিক সহযোগিতা করতে পারে। যেমন- বাংলাদেশ ভারতে গিয়ে মরুভূমিতে যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ নিতে পারে, সুউচ্চ পর্বতে প্রশিক্ষণ নিতে পারে। বঙ্গোপসাগরে যৌথ মহড়া করতে পারে। বাংলাদেশে যন্ত্রপাতি কম, কিন্তু আধুনিক। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণে খরচ অনেক বেশি। এক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। গোলটেবিল বৈঠকে অন্যদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ. পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ সিংহ রায়, সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু, শ্যামল দত্ত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর