সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করলে বিচার হাতে তোলা যাবে না আইন

ব্লগার রাজীব হত্যায় দুজনের ফাঁসি ও ছয় জনের জেল বহাল
বাবা বললেন, ন্যায় বিচার পাইনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করলে বিচার হাতে তোলা যাবে না আইন

রাজীব

ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলার রায়ে হাই কোর্ট ইমামদের উদ্দেশ্যে পর্যবেক্ষণে বলেছে, মসজিদের একজন ইমামের দায়িত্ব নামাজ পড়ানো এবং ইসলামের জ্ঞান মুসল্লিদের দেওয়া। ইমাম সাহেবরা এমন কোনো বয়ান দেবেন না- যা প্রচলিত আইন বহির্ভূত। গতকাল বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ রাজীব হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের উপর রায় দেয়। পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, যদি কেউ ইসলাম, হযরত মুহাম্মদ (সা.), কিংবা অন্য কোনো ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন বা ফেসবুকে পোস্ট দেন-তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে  নেওয়ার অধিকার কারও নেই। আদালতের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, এই হত্যা মামলার সাক্ষ্য, দলিলাদি ও আসামিপক্ষের যুক্তি থেকে দেখা যায়, মুফতি রাহমানী ছাড়া বাকি সাতজন মেরিটোরিয়াস স্টুডেন্ট। কিন্তু তারা  কেন এই পথে গেলেন- সেটা আমরা খুঁজে পাইনি। অবশ্য এ পথে যাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। কেউ কেউ বলেন, অভিভাবকদের দায় বহন করতে হবে। অভিযুক্তদের অভিভাবকেরা শিক্ষিত ও উচ্চ অবস্থানে আছেন। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, আমাদের অনেক গার্ডিয়ান নিজেদের লাইফস্টাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাচ্চাদের মানসিকতা ও ইচ্ছা বিবেচনায় না নিয়ে অ্যারিস্টোক্রেসি মেনটেইন করার জন্য যে কোনো পড়াশোনা তাদের উপর আমরা চাপিয়ে দেই। যা সঠিকভাবে তাদের বাড়তে দেয় না। তারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, অভিভাবকেরাই সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষক। এ ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিবেশ, রাজনীতি, ধর্মীয় আচার-ব্যবহার, স্বাধীনতার ইতিহাস যথাযথভাবে শিশুদের শিক্ষা দিতে হবে। এ নিয়ে সবাইকে এবং সরকারকেও ভাবতে হবে। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, এ হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত। একদল হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছে, অন্যরা তথ্য সংগ্রহ করেছে।

রাজীব হত্যায় দুজনের ফাঁসিসহ ছয়জনের কারাদণ্ড বহাল : গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ ও রেদোয়ানুল আজাদ রানার ফাঁসির আদেশ হাই কোর্টে বহাল রয়েছে। এ ছাড়া এ মামলায় মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ বিচারিক আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত অন্য ছয়জনের সাজাও উচ্চ আদালতে বহাল রয়েছে। রাজীব হত্যা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিলের শুনানি শেষে গতকাল বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেয়। কারাদণ্ড পাওয়া আসামিদের সাজা বাড়াতে রাজীবের বাবার করা আবেদন খারিজ করেছে হাই কোর্ট। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানী ছাড়া অন্য আসামিরা বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। তবে রায়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন রাজীবের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এ রায়ে ন্যায়বিচার পাইনি। সরকার বলে, তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। এ দেশের সরকার জঙ্গি দমনে বদ্ধপরিকর। কিন্তু আদালতে এসে তার প্রমাণ পাইনি। আদালতের রায়ে তার প্রতিফলন নেই। এ রায় প্রত্যাখ্যান করছি।’ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আতিকুল হক সেলিম ও বিলকিস ফাতেমা। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবদুর রেজাক খান, মোশাররফ হোসেন কাজল ও মো. আহসান উল্লাহ। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরের কালশীতে নিজের বাসার কাছে চাপাতি হামলায় খুন হন আহমেদ রাজীব হায়দার। উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তিনি অনলাইনে লেখালেখি করতেন। এ মামলায় ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর রায়ে দুই আসামিকে মৃত্যুদণ্ডসহ অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়। পরে কারাগারে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য মামলাটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাই কোর্টে আসে। এ ছাড়া কারাগারে থাকা আসামিরাও আপিল ও জেল আপিল করেন। একসঙ্গে ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিলের শুনানি হয়। আসামিদের মধ্যে রানা পলাতক থাকায় আপিল করার সুযোগ পাননি। ৯ জানুয়ারি আপিল শুনানি শেষে হাই কোর্টে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি রানা গ্রেফতার হন। বিচারিক আদালতের রায়ে রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। মাকসুদুল হাসান অনিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাদের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, দুই হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে তিন বছরের কারাদণ্ড, দুই হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। হাই কোর্টে ওই সাজাই বহাল রইল।

সর্বশেষ খবর