মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সরকারি নিয়োগে ভয়াবহ বাণিজ্য

দফতরি পিয়ন ঝাড়ুদার শিক্ষক নিয়োগেও লাখ লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্য, পুলিশ নিয়োগে দরদাম হাঁকানো হয়, টিআর-কাবিখার বড় অংশ যায় জনপ্রতিনিধিদের পকেটে

মাহমুদ আজহার

সরকারি নিয়োগে ভয়াবহ বাণিজ্য

দেশের প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়েছে কিছুদিন আগে। এসব স্কুলে এক লাখেরও বেশি শিক্ষককে জাতীয়করণ করা হয়। এ জন্য জেলা-উপজেলা পর্যায়ে গঠন করা হয়েছিল একটি ‘যাচাই-বাছাই’ কমিটি। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ এলাকায় ওই কমিটি শিক্ষকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উেকাচের বিনিময়ে চাকরি জাতীয়করণ করেন। সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এ কমিটি হলেও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল অনেক এলাকায়। শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ লেনদেন এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে এলাকাভেদে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ পাচ্ছেন অপেক্ষাকৃত অযোগ্যরা। অন্যান্য শিক্ষক নিয়োগেও নেওয়া হয় ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। জাতির শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে ‘ডোনেশনের’ নামে ঘাটে ঘাটে গুনতে হয় ঘুষ।

শুধু শিক্ষক নিয়োগই নয়, প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের দফতরি, পিয়ন, ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে সব নিয়োগে লাখ লাখ টাকার ‘ঘুষ বাণিজ্য’ হচ্ছে। পুলিশ কনস্টেবল ও এএসআই নিয়োগেও দরদাম হাঁকানো হয় এখন। এসব নিয়োগ এখন ওপেন সিক্রেট। বাজারদরের মতো নিয়োগের দামও বাড়ছে হু হু করে। দেখার কেউ নেই। যোগ্যতার মাপকাঠিকে পাশ কাটিয়ে টাকার বিনিময়ে হচ্ছে চাকরি। জানা যায়, ভয়াবহ এ নিয়োগ-বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তারাও জড়িত। টাকার বিনিময়ে সব সময় যে সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকদের চাকরি হচ্ছে তাও নয়। বিরোধী দলের সমর্থকরাও উেকাচের বিনিময়ে চাকরি নিচ্ছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের একটি সিন্ডিকেট এ অনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। তবে এ নিয়ে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের বড় অংশেরই ক্ষোভ বেশি। তাদের মতে, একটি প্রভাবশালী শ্রেণি টাকার বিনিময়ে সরকারবিরোধীদেরও নিয়োগ দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের। এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় ঘুষ দেয় না, বাধ্য হয়েই দেয়। যারা গ্রহণ করেন তাদের চিহ্নিত করা সরকারের জন্য তেমন কোনো সমস্যা নয়। সরকারি নিয়োগ-বদলির ক্ষেত্রে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবই বেশি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে গেছে। যারা ক্ষমতায় থাকেন, কোনো না কোনোভাবে প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। সেসব প্রতিষ্ঠানেও ঘুষ-দুর্নীতি বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের পাশাপাশি সরকারি সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকেই সতর্ক দৃষ্টি থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে যুগোপযোগী আইনও করা উচিত।’ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে, সরকারি সেবা নিতে গিয়েই বেশি ঘুষ দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে পাসপোর্ট, পুলিশ প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা খাতেই ঘুষ-দুর্নীতি বেশি। সরকারি খাতে সেবা নিতে গিয়ে প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষ ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এটা ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। ঘুষ না দিলে সেবা পাবেন না। তাই বাধ্য হয়েই তারা ঘুষ দিয়েছেন। জানা যায়, দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে টাকার প্রতিযোগিতাই বেশি। স্কুলের পরিচালনা কমিটি থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষা কর্মকর্তা প্রত্যেককেই নির্দিষ্ট অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়। নিয়োগের পর এমপিওভুক্ত হতেও থানা, জেলা শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে আঞ্চলিক কার্যালয় পর্যন্ত পদে পদে দিতে হয় টাকা। স্কুলে নিয়োগ থেকে এমপিওভুক্ত হতে ৪  থেকে ১০ লাখ টাকা অনৈতিক পথে খরচ করতে হয় শিক্ষকদের। আর এই নিয়োগ-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে উপজেলা পর্যায়ে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, দেশে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার  বেসরকারি স্কুল রয়েছে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত স্কুলই রয়েছে ১৫ হাজার ৯৮৪টি। প্রতিটি স্কুলেই প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, সহকারী লাইব্রেরিয়ান, বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, কর্মচারী ও গার্ড রয়েছেন। অবসরে যাওয়ার পর বা নানা কারণে চাকরিচ্যুত হওয়ার পর এসব পদ শূন্য হয়। ওই সব পদে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া শূন্য পদের বাইরেও শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে থাকে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি। দেশের বেসরকারি এমপিওভুক্ত স্কুলে শিক্ষক আছেন প্রায় ২ লাখ। প্রতি মাসে গড়ে স্কুল ও কলেজের কমবেশি ১ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত হন। স্কুলের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরই একজন শিক্ষক এমপিওভুক্তির  যোগ্য হন। তবে এমপিওভুক্ত হওয়ার আগেই টাকা দিতে হয় নিয়োগ কমিটিকে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধান শিক্ষক পদে এলাকাভেদে ১০ থেকে ১৫ লাখ, সহকারী শিক্ষক পদে ৮ লাখ, ভোকেশনাল শিক্ষক পদে ৭ লাখ ও মাদ্রাসায় শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতে হলে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়া এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে শুধু শিক্ষক পদে নয়, এমএলএসএস ও নৈশপ্রহরী পদেও লাখ লাখ টাকার অনৈতিক লেনদেন হচ্ছে।

জানা যায়, জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসক কার্যালয় ও উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর, সাঁটমুদ্রাক্ষরিক-কাম-কম্পিউটার অপারেটর, লাইব্রেরি সহকারী, অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, অ্যাকাউনটেন্ট ক্লার্ক, সার্টিফিকেট সহকারীসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগেও গুনতে হয় লাখ লাখ টাকার ঘুষ। সে ক্ষেত্রে সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতার পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের কর্তারাও এ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হন। জানা যায়, ঘুষ ছাড়া চাকরি পাওয়া দায় পুলিশে। ঘুষকে এখন অন্যায় মনে করা হয় না। এলাকাভেদে একজন কনস্টেবল নিয়োগে গুনতে হয় ৪ থেকে ৮ লাখ টাকা। এসআই বা এএসআই পদে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। তবে ঢাকায় ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ আরও বেশি বলে জানা যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ পেতেও ৪-৫ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। স্বাস্থ্যসেবায় মাঠকর্মী নিয়োগে সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্টদের ঘুষ দিতে হয় অন্তত ৪ লাখ টাকা। দফতরি ও পিয়ন নিয়োগেও দিতে হয় সমসংখ্যক টাকা। ডিসি অফিস, জেলা পরিষদ প্রশাসক কার্যালয়সহ জেলা পর্যায়ে দায়রা জজ আদালতেও রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়োগ-বদলি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, টিআর-কাবিখা লুটেপুটে খাচ্ছেন এমপিদের একটি অংশ। সরকারি দরে এক টন চালের দাম ৩৭ হাজার টাকা নেওয়া হলেও ৫ হাজার টাকাও খরচ করতে চান না এমপিরা। একই অবস্থা গম বরাদ্দেও। টনপ্রতি দাম ২৭ লাখ টাকা নেওয়া হলেও প্রায় সব টাকাই চলে যায় এমপিদের পকেটে। দল ও সংসদের কাছে জনপ্রতিনিধির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়ানো জরুরি। ভুক্তভোগীরা জানান, স্থানীয় পর্যায়ে এমপির নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের হিস্যা হাতিয়ে নেওয়ার পরই নিয়োগপত্র নিশ্চিত করা হয়। কোথাও নিয়োগ-বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি করে নেন এমপি ও সরকারি কর্মকর্তারা। নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকা আদায় ও বণ্টনে দলীয় লোকজন বা এমপি ভাগ না পেলেই বাধে ঝামেলা। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ তুলে বন্ধ করা হয় নিয়োগ প্রক্রিয়া। বিধি মোতাবেক আবেদন-নিবেদন, লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, যাচাই-বাছাই ও মেধার কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কে আগে টাকা পরিশোধ করছেন এর ভিত্তিতেই তৈরি হয় চূড়ান্ত নিয়োগ তালিকা। অনেক এলাকায় চাকরির ইন্টারভিউ বা লিখিত পরীক্ষার দিন প্রকাশ্যে টাকা লেনদেনের হাট বসে।

সর্বশেষ খবর