মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

আইনের আশ্রয়ে তিন মেয়র

বিশেষজ্ঞরা বললেন, বিষয়টি দুঃখজনক

নিজস্ব প্রতিবেদক

আইনের আশ্রয়ে তিন মেয়র

মোসাদ্দেক হোসেন - আরিফুল হক - জি কে গউছ

বরখাস্ত হওয়ার মাত্র এক দিনের মাথায় হাইকোর্টে রিট করে মেয়র পদ ফিরে পেয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) আরিফুল হক চৌধুরী। আইনের আশ্রয় নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ। তারা দাবি করেছেন, রাজনৈতিক কারণেই তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। এটা ষড়যন্ত্রের অংশ। তারা আইনের আশ্রয় নেবেন। অন্যদিকে বিষয়টিকে দুঃখজনক উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইনটির সঠিক ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহার বেশি হচ্ছে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে অপরাজনীতির সংস্কৃতি ফিরে আসছে। যেসব অপরাধের কারণে তাদের বরখাস্ত করা হচ্ছে সে বিষয়গুলোর আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা দিতে হবে। তা না হলে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে যে আইনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা হচ্ছে সে বিধানটি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। আরিফের বরখাস্তের আদেশ স্থগিত : সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে দ্বিতীয় দফায় সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশ তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। একটি রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে গতকাল বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। সিলেটের সিটি মেয়রকে সাময়িক বরখাস্তের ওই আদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে স্থানীয় সরকার সচিব, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, সিলেটের জেলা প্রশাসক, সিলেটের পুলিশ কমিশনারসহ ছয়জনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন। সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুল হালিম কাফি। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার। বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী উচ্চ আদালতের ছাড়পত্রে ২ এপ্রিল মেয়রের দায়িত্বে ফেরার পরপরই তাকে আবারও বরখাস্ত করে সরকার। সিলেটের মেয়র আরিফের বিরুদ্ধে করা একটি ফৌজদারি মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্র ২২ মার্চ সুনামগঞ্জের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে গৃহীত হওয়ার ঘটনায় স্থানীয় সরকার (সিটি কপোরেশন) আইন অনুযায়ী তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

রিট করবেন বুলবুল ও গউছ : সাময়িক বরখাস্ত হওয়া রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল আজ হাইকোর্টে রিট করবেন বলে জানিয়েছেন। গতকাল তিনি আইনজীবীর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। এদিকে হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ আজ বা আগামীকাল হাইকোর্টে রিট করবেন বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান।

বিধানটি পুনর্বিবেচনা দরকার : স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনটির সঠিক ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহার বেশি হচ্ছে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে অপরাজনীতির সংস্কৃতি ফিরে আসছে। আজ যারা সরকারি দলে আছে, ভবিষ্যতে বিরোধী দলে থাকলে তাদেরও এ বিধানটি নিয়ে সাফার করতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে তারা এমন মন্তব্য করেন। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলা-মোকদ্দমার কারণে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের (ইউপি, পৌরসভা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন) ‘সাময়িক বরখাস্ত’ করা নতুন নয়। সর্বশেষ তিনজন সিলেটের আরিফুল হক, রাজশাহীর বুলবুল ও  হবিগঞ্জের গউছ যুক্ত হলেন। এ তিনজনের সময়ে বরখাস্তের ক্ষেত্রে যে কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে তা দুঃখজনক ও অত্যন্ত নাটকীয়। তাদের তিনজনই সুনির্দিষ্ট সময় কারা ভোগ করেছেন। কারাভোগের পর উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ পেয়েছেন এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর মন্ত্রণালয় তিনজনের পক্ষেই পুর্নবহালের নির্দেশ জারি করেছিল। ওই নির্দেশ প্রতিপালিত হওয়ার দিনই একসঙ্গে তিনটা নির্বাহী আদেশ জারি করে তাদের পুনরায় দ্বিতীয়বারের মতো সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। এ বিষয়টি রহস্যজনক মনে হয়। ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্ব ধারাবাহিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিকতার স্বার্থে সাময়িক বরখাস্তের বিধানটি পুনর্বিবেচার দাবি রাখে। কারণ অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এই আইনটির সঠিক ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহার বেশি হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে এ আইনের বিশেষ ধারাটি ব্যবহারের অনেক সুযোগ রয়েছে। প্রচলিত আইনে দেখা যায়, যে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সময় ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত অপরাধীও উচ্চ আদালতে আপিল করে প্রার্থী হতে পারেন। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দণ্ডিত হওয়ার আগে অভিযোগপত্রের ভিত্তিতেই বরখাস্ত হয়ে যান। এ ক্ষেত্রে আইনটা সংগতিবিহীন। এ বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। অনেক সময় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সংঘাতপূর্ণ ও অপরাজনীতির শিকার হয়ে মিথ্যা মামলায় কেউ ফেঁসে যেতে পারেন। তিনি বলেন,  ফৌজদারি মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে যেহেতু অনেক সময় ব্যয় হয়, সে ক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তির পর নির্দোষ প্রমাণিত হলেও তাকে ওই সময়টা ফেরত দেওয়া যায় না। এভাবে একজন প্রতিনিধিকে বঞ্চিত করা হয়। যারা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন তারাও নিজেদের বঞ্চিত বোধ করেন। তাই প্রথমত সর্বক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত। মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া দরকার। তোফায়েল বলেন, মন্ত্রণালয়ের একটি তথ্যে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ এক বছরের মধ্যে ২৪ জন মেয়র, ২৮ জন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ১৩ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ১৫০ ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য সাময়িক বরখাস্তের আওতায় এসেছেন।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তিনজন নির্বাচিত মেয়র দায়িত্ব পালন করতে পারলেন না। শুধু এই তিনজনের ক্ষেত্রেই নয়, বিরোধী দলের এ রকম কয়েকশ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, এ ধারা শুধু বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধির জন্য, না সবার জন্য প্রযোজ্য? শুধু বিরোধী দলের সঙ্গে যুক্ত তারাই কি ফৌজদারি অপরাধ করেন? নাকি সরকারি দলের জনপ্রতিনিধিরা এ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত? এটা অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা প্রদশিত হচ্ছে কি না? রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা প্রদর্শনের পরিণাম মঙ্গলকর নয়। এর মাধ্যমে যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হচ্ছে, অন্য দল ক্ষমতায় এলেও তা কাজে লাগাতে পারে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে অপসংস্কৃতি সৃষ্টি হচ্ছে। এর অবসান হওয়া দরকার। শুধু এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যই অমঙ্গলকর নয়, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জন্যও ইতিবাচক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যাদের বরখাস্ত করা হচ্ছে, যেসব অপরাধের জন্য বরখাস্ত করা হচ্ছে, সেগুলো পরিষ্কার করা উচিত। বরখাস্তের বিষয়টি যেভাবে আসছে, কারণগুলো সেভাবে আসছে না। ফলে জনগণের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়টি সরকারকে পরিষ্কার করতে হবে। না হলে বিএনপি এগুলোকে ইস্যু করে আন্দোলন করবে। মানুষকে ভুল বোঝাবে। তিনি বলেন, যাদের বরখাস্ত করা হচ্ছে তাদের সঠিক কারণেই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কারণ অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে। অপরাধী তো অপরাধীই, সেটা স্থানীয় সরকার হোক আর জাতীয় সরকারই হোক। সাত খুনের মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নুর হোসেনের মতো লোকরাও জনপ্রতিনিধি নির্বাচতি হন। আবার যুদ্ধাপরাধী, মাফিয়া ডনরা জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। সুতরাং জনপ্রতিনিধি হলেই সবাই আইনের ঊর্ধ্বে চলে যাবেন এটা ভাবার কারণ নেই। এতে করে স্থানীয় দুর্বল হবে না।

বরং আবর্জনা পরিষ্কার হবে। স্থানীয় সরকার আরও শক্তিশালী হবে। ভালো মানুষ জায়গা পাবে, যেটা রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ড. জিনাত হুদা বলেন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করতে চাইলে ভালো মানুষ, মানবিক চেতনাসম্পন্ন, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নেতৃত্ব তুলে আনতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর