মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

আস্তানায় নিহতদের লাশ নেবেন না স্বজনরা

জঙ্গি সন্দেহে আটক ৭

মৌলভীবাজার ও ময়মনসিংহ প্রতিনিধি

মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত নারী-শিশুসহ ৭ জনের মরদেহ শনাক্ত করেছেন স্বজনরা। তবে কলঙ্কের গ্লানি নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে তারা লাশগুলো ফেরত নেবেন না বলে জানিয়েছেন। এদিকে, বড়হাট এলাকার জঙ্গি আস্তানায় অপারেশন ম্যাক্সিমাস চলাকালে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হয় তিন জঙ্গি। তাদের মধ্যে একজন আশরাফুল আলম নাজিম নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার বাসিন্দা বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ। গতকাল দুপুরে মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহ জালাল। তিনি বলেন,  নিহতদের শনাক্ত করতে নিহত লোকমান হোসেনের শ্বশুর আবু বক্কর সিদ্দিক দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ডাঙ্গা গ্রাম থেকে এসেছেন। কিন্তু ছিন্নভিন্ন মরদেহ থাকায় তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি; তবে ওই বাড়িতে পাওয়া একটি গ্রুপ ছবি দেখালে তিনি তা শনাক্ত করেন। ওই বাড়ির কেয়ারটেকার জুয়েলও ছবি দেখে শনাক্ত করে জানায়, তারা ওই বাড়িতে বাস করত। লাশ শনাক্ত করতে মৌলভীবাজারে আসেন লোকমানের শ্বশুর আবু বক্কর সিদ্দিক, ভায়রা সানোয়ার হোসেন ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মোফাজ্জল হোসেন। তবে মরদেহগুলো স্বজনরা গ্রহণ করবে না বলে জানায়। মৌলভীবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. অকিল উদ্দিন বলেন, যেহেতু পরিবার লাশ নিতে চাইছে না এখন পৌরসভা লাশগুলো দাফন করার ব্যবস্থা করবে। আবু বক্কর সিদ্দিকের দেওয়া তথ্য মতে, তার বড় মেয়ে শিরিন আক্তার (৩৫), তার স্বামী লোকমান হোসেন (৪৫), তাদের বড় মেয়ে আমেনা খাতুন (২০), মেয়ে সুমাইয়া (১২), মরিয়ম (১০), ফাতেমা (৭), খাতিজা (সাত মাস) পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। অন্যদিকে নিহত লোকমানের পরিবারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না বলে জানা গেছে। লোকমানের বাবা নুরুল ইসলাম জানতেন ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করে। প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার রাতে মৌলভীবাজারের বড়হাট ও নাসিরপুরে দুই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। পরে বুধবার বিকালে ঢাকা থেকে আসা সোয়াত দল প্রথমে নাসিপুরের আস্তানায় অভিযান চালায় কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে ওই দিন অপারেশন সমাপ্ত করতে পারেনি। পরদিন বৃহস্পতিবার দিনভর অভিযান চালিয়ে সফল হয় সোয়াত। অভিযানের সময় বিস্ফোরণে ঘটে মারা যায় নারী-শিশুসহ ৭ জন।

ময়মনসিংহে দরজা ভেঙে জেএমবির সাত জঙ্গি আটক : এবার ময়মনসিংহ নগরীর কালিবাড়ী এলাকার একটি চৌচালা বাসায় অভিযান চালিয়ে নব্য জেএমবি সন্দেহে সাতজনকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল বেলা ১টার দিকে প্রথমে ওই বাড়িটি ঘেরাও করে পুলিশ। পরে দরজা ভেঙে তাদের আটক করা হয়। বেলা সোয়া ৩টার দিকে পুলিশের একটি গাড়িতে করে তাদের চোখ ও হাত বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ময়মনসিংহ গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আটক ব্যক্তিরা হচ্ছেন হালুয়াঘাট উপজেলার শহিদুল ইসলাম (৩৫), আশিকুর রহমান (১৯), ধোবাউড়া উপজেলার আল-আমিন (২৫), নেত্রকোনার জেলার পূর্বধলা উপজেলার মাসুম আহমেদ (৩০) ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নাসির উদ্দিন (২৩)। এ ছাড়া ছদ্মনামে রোমান মিয়া (২৫) ও শাহ আল হাসান শামীমকে (২৫) আটক করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, অভিযানের সময় তাদের কাছ থেকে বিপুলসংখ্যক জিহাদি বই, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। পাওয়া যায় ৭০ লাখ টাকার চেক। এদের মধ্যে একজন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থী বলে জানিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বড় ধরনের ঘটনা ঘটানোর আগেই আমরা তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছি। চার মাস আগে তারা বাসাটি ভাড়া নেয়। তাদের বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও নেত্রকোনায়।’ সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নগরীর কালিবাড়ী রোডের সোহাগ পার্টি সেন্টারের সামনে একটি সরু গলি। গলির শেষ মাথার বাঁ পাশে একটি বড় গেটের ভিতর সূর্যের হাসি চিহ্নিত তিনতলা একটি ক্লিনিক। এর ঠিক পাশেই চৌচালা একটি বাড়ি। বাড়িটি এমপিএ মরহুম আনোয়ারুল কাদিরের। বর্তমানে বাড়িটি তার ছেলে অ্যাডভোকেট আসিফ আনোয়ার মুরাদ দেখভাল করছেন। তিনি ঢাকায় থাকেন বলে জানা গেছে। পুলিশ জানায়, বাড়ির মালিকের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করা যায়নি। বাড়ির ভিতর কোনো টিভি না থাকলেও ছিল কম্পিউটার, ওয়াইফাই রাউটার। কম্পিউটারে লেখা ছিল—‘ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার লক্ষ্য’। সন্দেহভাজন নব্য জেএমবি সদস্যদের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার পর বাড়িটিতে তল্লাশি চালায় সিআইডির একটি বিশেষ টিম। এ ছাড়া পুরো বাড়িটি ঘিরে রেখেছেন পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সদস্যরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন রেঞ্জ ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, র‌্যাব-১৪ কমান্ডিং অফিসার (সিও) লে. কর্নেল শরীফুল ইসলামসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার ও কুমিল্লার জঙ্গি আস্তানার রেশ কাটতে না কাটতে ময়মনসিংহে জঙ্গি আস্তানার খবর মুহূর্তেই শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গোটা ময়মনসিংহ। যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয় নগরীর র‌্যালি মোড় থেকে থানাঘাট মোড় পর্যন্ত। ঘটনাস্থলসহ আশপাশ এলাকায় মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত র‌্যাব-পুলিশ। গোটা নগরী মুড়িয়ে দেওয়া হয় নিরাপত্তার চাদরে। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) নূরে আলম জানান, ধারণা করা হচ্ছে এরা সবাই নব্য জেএমবির সদস্য। বাড়ির ভিতর পাওয়া যায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের লেখা ৫০টি জিহাদি বই। আটকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের পর আরও বিস্তারিত জানা যাবে বলেও জানান তিনি। রেঞ্জ ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, আটক সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জেলা গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল ও সবুজ জানান, বছরখানেক আগে বাড়িটি ভাড়া দেওয়া হয়। বাড়িটিতে কয়েকজন যুবক থাকত। বাসায় সব সময় দরজা-জানালা বন্ধ থাকত। মাঝেমধ্যেই ঘরের ভিতর আজান দেওয়া হতো। এ ছাড়া তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা নিজেদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিল বলে পরিচয় দিত।

সর্বশেষ খবর