বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

বৈষম্যমুক্ত বিশ্বের অঙ্গীকার

আইপিইউ সম্মেলন শেষ, অন্য দেশের হস্তক্ষেপ বন্ধসহ ৫ দফা ঢাকা ঘোষণা

আহমদ সেলিম রেজা

বৈষম্যমুক্ত বিশ্বের অঙ্গীকার

ঢাকায় পাঁচ দিনব্যাপী ‘ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন—আইপিইউ অ্যাসেম্বলি’ গতকাল শেষ হয়েছে। ১৩৬তম এই সম্মেলন বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বানসহ চারটি স্থায়ী কমিটির ১৮ দফা রেজুলেশন ও বৈষম্য কমাতে পাঁচ দফা কর্মসূচিসংবলিত ‘ঢাকা ঘোষণা’র মাধ্যমে শেষ হয়। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত ‘ঢাকা ঘোষণা’র মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সফল সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনের সাধারণ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। সম্মেলনে গৃহীত ঢাকা ঘোষণায় নীতিগত ও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ, আইনি কাঠামো ও সংসদকে আরও শক্তিশালীকরণ, তরুণদের কর্মসংস্থান করাসহ পাঁচ দফা উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া কোনো সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ বন্ধ, জঙ্গিবাদ নির্মূলে অর্থায়ন বন্ধ, এমপিদের মানবাধিকার রক্ষা, নারীদের ক্ষমতায়নে অর্থায়ন নিশ্চিত করার জন্য সম্মেলন থেকে রেজুলেশন নেওয়া হয়েছে।

আইপিইউ পরিচালনা পরিষদের সমাপনী অধিবেশনে এসব রেজুলেশন গৃহীত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। বক্তব্য দেন আইপিইউর মহাসচিব মার্টিন চুনগং। তিনি সফলভাবে সম্মেলন আয়োজনের জন্য বাংলাদেশকে অভিনন্দন জনান। এ সময় বিপুল কারতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সম্মেলন কেন্দ্র। এরপর আগামী অক্টোবরে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে ১৩৭তম আইপিইউ অ্যাসেম্বলির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।

শেষে ঢাকা ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে সম্মেলনের সভাপতি ও বাংলাদেশের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সফলভাবে এই সম্মেলন শেষ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘তার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে সিপিএ (কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন) এবং আইপিইউর মতো দুটি মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হতে পেরেছে। তারই সার্বিক তত্ত্বাবধানে সফলভাবে এই সম্মেলন শেষ করতে পেরেছি।’ তিনি আরও বলেন, এই সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ‘বৈষম্য নিরসনে সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিতকরণ’। এ বিষয়ে সম্মেলনে অংশ নেওয়া স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ দেশের পক্ষে সুনির্দিষ্ট যেসব প্রস্তাব তুলে ধরেছেন, তারই প্রতিফলন ঘটেছে ঢাকা ঘোষণায়। এর মধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য কমানোর অঙ্গীকার এবং এ বিষয়ে নীতিগত ও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ, তরুণদের কর্মসংস্থান করা, আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণ, সংসদকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকরকরণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা আরও বৃদ্ধিকরণ। আইপিইউর সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে উত্থাপনের মাধ্যমে ঢাকা ঘোষণাকে কার্যকর করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। নতুবা এই ঘোষণা একটি কাগুজে ঘোষণা বা দলিলে পরিণত হবে। তিনি আরও বলেন, এর আগে হ্যানয় ঘোষণা ভিয়েতনামের সংসদে গ্রহণের মাধ্যমে তাকে আইনগত ভিত্তি দেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চলতি সম্মেলনে উত্থাপিত সব এজেন্ডার বিষয় আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়েছে। কোনো এজেন্ডা পেন্ডিং নেই। গৃহীত রেজুলেশনে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য বিশ্বব্যাপী জনগণের মধ্যকার স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বৈষম্য দূর করে সবার জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। অর্থনৈতিক অসমতা লিঙ্গবৈষম্যসহ নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে বিধায় অসমতার মৌলিক কারণগুলো দূর করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়। পাশাপাশি সংসদ সদস্যদের মানবাধিকার সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী সংসদ সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং বিভিন্ন দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে জনগণের মানবিক মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। সম্মেলনে বলা হয়, আর্থিক খাতে পুরুষদের থেকে নারীরা এখনো পিছিয়ে। তাই নারীদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করতে হবে। সম্মেলনে মোট ১৩২টি দেশের ৪৫ জন স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও সংসদ সদস্যসহ মোট ১ হাজার ৩৪৮ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ এপ্রিল বৃহত্তম এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।

বৈষম্যমুক্ত বিশ্ব বিনির্মাণের অঙ্গীকারে ভাঙল আইপিইউ এমপিদের মিলনমেলা : বৈষম্যমুক্ত বিশ্ব গড়া এবং শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার অঙ্গীকারে ভাঙল আইপিইউর এমপিদের মিলনমেলা। জেনেভা থেকে শান্তির অন্বেষণে পৃথিবীর সব পথ এসে মিশেছিল ঢাকায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংসদীয় রাজনীতির সংগঠন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম আন্তর্জাতিক এই সম্মেলন উপলক্ষে ১৭১ দেশের এমপি ও সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিদের পদচারণে মুখরিত হয়েছিল ঢাকা। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার উন্মুক্ত মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কেন্দ্রের রুদ্ধদ্বার কক্ষ বা সাধারণ অধিবেশনে সর্বত্রই উচ্চারিত হয়েছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যমুক্ত বিশ্ব এবং শান্তি ও নিরাপত্তার অঙ্গীকারের কথা। টেবিলের নিরাপত্তা ইস্যু থেকে রাজপথের নিরাপত্তাসহ আতিথেয়তায় মুগ্ধ ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকান দেশের প্রতিনিধিরাও। সম্মেলনের ব্যস্ততার কারণে কোনো অতিথি যেন বাংলাদেশের অপরূপ প্রকৃতি, কর্মময় জীবন ও সংস্কৃতির পাশাপাশি এ দেশের উৎপাদিত বিশ্বমানের প্রোডাক্ট এবং শিল্পায়নে উন্নয়নের ধারা উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত না হন এ জন্য সম্মেলনস্থলের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছিল একটি মিনি বাংলাদেশের পরিকাঠামো। নাম দেওয়া হয়েছিল আইপিইউ বাণিজ্য মেলা ও প্রদর্শনী। ১৩৬তম আইপিইউ অ্যাসেম্বলি উপলক্ষে ১ থেকে ৫ এপ্রিল ঢাকার সার্বিক আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অতিথিরা। মুক্তকণ্ঠে প্রকাশ করেছেন উচ্ছ্বাস। সম্মেলনের শেষ দিন প্রকাশ করা হলো ‘ঢাকা ঘোষণা’। এর আগে নির্বাহী কমিটির সভায় ঘোষণা করা হলো ঢাকা থেকে আইপিইউর পথ আগামী অক্টোবরে গিয়ে মিশবে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যমুক্ত বিশ্ব এবং শান্তি ও নিরাপত্তার অন্বেষণে এভাবেই অবিরাম চলতে থাকবে আইপিইউর পথচলা। এরপর প্রদর্শিত হয় সেন্ট পিটার্সবার্গের ওপর একটি তথ্যচিত্র। এর আগে ঢাকায় আগত আইপিইউ সদস্য ও পর্যবেক্ষক প্রতিনিধির হাতে তুলে দেওয়া হয় সেন্ট পিটার্সবার্গের আমন্ত্রণপত্র।

‘বাংলাদেশের নিরাপত্তা অনেক ভালো’ : আইপিইউ আয়োজন ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আইপিইউ সম্মেলনে অংশ নেওয়া সুইডেনের সংসদ সদস্য তেরেস লিন্ডবার্গ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ অনেক সুন্দর দেশ। এখানে এসে অনেক ঘুরব, কেনাকাটা করব বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু আমাদের চলাফেরায় অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তাই ঘোরাঘুরি করা হচ্ছে না। তবে মেলার আয়োজন করে খুব ভালো করেছে। কেনাকাটা করা যাচ্ছে। এ ছাড়া এখানে নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেক ভালো।’ এ সময় বাংলাদেশের মানুষের প্রশংসাও করেন তেরেস লিন্ডবার্গ। তিনি বলেন, ‘এ দেশের মানুষ অনেক ফ্রেন্ডলি (বন্ধুত্বপূর্ণ) ও অতিথিপরায়ণ।’ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ সমস্যা শুধু কোনো একটিমাত্র দেশের সমস্যা নয়। এটা বিশ্বব্যাপী সমস্যা। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে একটি সংসদ রয়েছে, বিরোধী দল রয়েছে। আশা করছি তারা গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’

প্রশংসা করলেন ফ্রান্সের এমপি : আইপিইউ সম্মেলনে ফ্রান্সের এমপি পোযো ডি বোরগো সন্ত্রাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, সন্ত্রাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ, এটা সবার দরকার। এটা সত্যি প্রশংসার। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ সবার জন্য শিক্ষা। তিনি বলেন, সন্ত্রাস জাতিগত সমস্যা নয়। এটা বিশ্বব্যাপী সমস্যা। এটা মোকাবিলায় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘ফ্রান্সে এখন সন্ত্রাসী আক্রমণ হচ্ছে। আমরা উদ্বিগ্ন। কিন্তু এটা সেখানকার প্রকৃত চেহারা নয়। সন্ত্রাসীরা আমাদের অনেক শিশু মারছে, অনেককে আহত করছে। এ জন্য তাদের সুরক্ষা দেওয়ার উপায় বের করতে হবে। চক্রান্তের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। তবে প্রতিটা দেশের সমস্যা নিয়ে তাদের নিজেদেরই ভাবতে হবে এবং নিজেদেরই তা সমাধান করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর