বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
কলকাতার চিঠি

জ্যোতি বসু করেছেন দশ মিনিটে, এখন লাগে দশ বছর

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

জ্যোতি বসু করেছেন দশ মিনিটে, এখন লাগে দশ বছর

সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম গত এক মাস ধরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে শেখ হাসিনার ভারত সফর যাতে সফল হয় এবং তিস্তার জলবণ্টন আর কালবিলম্ব না করে শুরু করা যায় সে ব্যাপারে। খবর তো আছেই, সম্পাদকীয়, উত্তর সম্পাদকীয়, বিশেষ প্রবন্ধ— কী নেই। সর্ব ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া পরপর কয়েকটি সম্পাদকীয়তে নরেন্দ্র মোদিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, ভারতের বিদেশনীতি সফল করতে হলে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব এবং সুসম্পর্ক স্থায়ী করতে হবে। সম্প্রতি টিভি চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে দিল্লি তাকে কিছুই জানায়নি। একজন মুখ্যমন্ত্রীকে মিথ্যাবাদী বলা রুচিতে বাঁধে। তিনি যে সম্পূর্ণ অসত্য বলেছেন, তার যথেষ্ট প্রমাণ ঢাকা ও দিল্লির কাছে আছে। মনমোহন সিং ২০১১ সালে ঢাকা সফরের আগে তিস্তাসহ বাংলাদেশের যাবতীয় চুক্তির বিষয় নিয়ে কলকাতায় তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে তিন-তিনবার পাঠিয়েছিলেন। মনমোহন সিং নিজে মমতার সঙ্গে দু-দুবার টেলিফোনে কথা বলেন। তৃতীয়বার বৈঠক স্থায়ী হয়েছিল মাত্র সাত মিনিটের। শিবশঙ্কর শেষ বৈঠকের দিন বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে উত্তেজিতভাবে আমাকে বলে গিয়েছিলেন, এই ভদ্র মহিলার সঙ্গে কথা বলা যায় না। আমি আপনাদের মুখ্যসচিবকে বলে এসেছি তাকে ইংরেজি শেখাতে। মোদি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বারবার মমতাকে টেলিফোনে তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারত সরকারের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছেন। মমতা ব্যানার্জি একবার একা হাসিনার আমন্ত্রণে ঢাকায় গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার তিনি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ঢাকা সফরে যান। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে ঢাকায় তাকে অনুরোধ করেছিলেন তিস্তার ব্যাপারে অমত না করার জন্য। বুধবার হাসিনার উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে চীনকে সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের জল নিয়ে ত্রিদেশীয় বৈঠক করবে। তার ওই উক্তি বৃহস্পতিবারের কাগজে দেখে দ্য টেলিগ্রাফ কাগজের ২০ বছরের সহযোগী সম্পাদক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ইমাম সাহেব সঠিক ইঙ্গিত দিয়েছেন। কারণ ঢাকা আর কতদিন মমতার ব্ল্যাকমেইলিং সহ্য করবে? এর একটা সীমা থাকা দরকার। তরুণবাবু একাই নন, আরও কয়েকজন প্রবীণ সাংবাদিক মনে করেন, বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান দেশ। তাদের জলের প্রয়োজন আছে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো, সেই কয়েক দশক আগে দেশ ছেড়ে চলে আসার ৬০ বছর পর বরিশালের নদ-নদীর খোঁজ করতে গিয়ে দেখেছিলাম, সেগুলোর অনেকগুলোই বুজে গেছে। ওই এলাকাও কৃষিপ্রধান। ভারতের সাংবাদিকরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যেভাবে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবির পক্ষে নেমেছে, তার উল্টো পথে হাঁটছে মমতার কেনা গোলামের মতো বুদ্ধিজীবীরা। তারা বর্তমানে কলকাতার মানুষের মন থেকে হারিয়ে গেছেন। তারাই এক সময় বাংলাদেশ বলতে হইহই করে লাফিয়ে পড়তেন।

আমরা কথা বলেছিলাম পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন আইএএস অফিসারদের সঙ্গে। তারা সবাই বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, মমতার কথা আমরা কোনো গুরুত্বই দিই না। তবে বিষয়টি যখন দুই দেশের মধ্যে সেখানে আমাদের দায়িত্ব আছে। যেহেতু আমাদের দেশ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। তাই দিল্লি সৌজন্যের খাতিরে রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলতে পারে। আবার দিল্লি এককভাবেও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মোদি কী করবেন আমরা জানি না। কিন্তু আমরা দেখেছি ফারাক্কা চুক্তির সময় জ্যোতি বসু এবং কংগ্রেসের গনি খান চৌধুরী টেলিফোনে ১০ মিনিট কথা বলে সমস্যা মিটিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু এখন তা ১০ বছর লেগে যাচ্ছে।

এদিকে কল্যাণ রুদ্রের মতো নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক আইনে যাকে বলে জওচঊজওঅঘ জওঐেঞ, সেই অনুযায়ী বাংলাদেশকে তিস্তাসহ যাবতীয় জল সমস্যার সমাধান দ্রুতগতিতে করতে হবে। মমতা নিযুক্ত ড. কল্যাণ রুদ্র কমিশনও এ অভিমত প্রকাশ করেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কংগ্রেস নেতা ওমপ্রকাশ মিশ্র একটু উত্তেজিত হয়ে বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো ঢাকায় গিয়েছিলেন। তখন মমতা তাকে বয়কট করলেন কেন? এর কৈফিয়ত ওনাকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে দিতে হবে। মমতা তো এখন সারদা-নারদা নিয়ে বাঁধা পড়ে গেছেন। আর তার উপদেষ্টারা অনেকেই এসেছেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক মনে করেন, বাংলাদেশকে মমতা পানিতে মারতে পারবেন না। উনি যতই লম্ফঝম্ফ করুন তিনি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিজেপির হাত ধরেছিলেন, সেকথা আমরা ভুলে যাইনি। তিনি রসিকতার ছলে বলেন, মমতা তো ঢাকায় গিয়ে হাসিনাকে বলেছিলেন, আপনারা পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ মাছ দিন। কিন্তু ইলিশ মাছ কি জলে হয় না ডাঙায়? হাসিনার সঙ্গে নানা বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর এবং চুক্তি করার ব্যাপারে মোদিও রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে অনুরোধ করেছেন, আপনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে বোঝান। প্রণব বাবুর ডাকে সাড়া দিয়ে মমতা দিল্লি যাবেন কিনা, এই লেখা পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে মোদি মনমোহনের কায়দায় উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদেরও ডেকেছেন। সম্ভবত এই মিটিং হবে ৮ এপ্রিল। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার দিল্লির বৈঠকে যোগ দিতে যাচ্ছেন। যাচ্ছেন আসাম এবং অন্য দুটি রাজ্যের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীরাও। এখন দেখা যাক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির দৌত্য কতটা সফল হয়। কারণ কংগ্রেস যখন পাঁচ বছর আগে প্রণব মুখার্জিকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছিল, তখন দিল্লির রাস্তায় দাঁড়িয়ে কুিসত ভাষায় গালাগাল করেছিলেন মমতা। বাংলাদেশের পাঠকদের তা নিশ্চয়ই মনে আছে। এপার বাংলার অধ্যাপকরা বিভিন্ন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলছেন মমতার কাণ্ডকারখানা কোনো বাঙালির মেনে নেওয়া উচিত নয়। যাই হোকে, সবাই প্রার্থনা করছেন এবং দাবি জানাচ্ছেন, হাসিনার আসন্ন ভারত সফর যেন ফলপ্রসূ হয়। তাহলেই দুই দেশের মধ্যে পুরনো সম্পর্ক ফিরে আসবে।

সর্বশেষ খবর