শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ব্যবসা বাণিজ্যে নতুন উচ্চতার লক্ষ্য

গুরুত্ব পাবে কানেকটিভিটি

রুহুল আমিন রাসেল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরে বাংলাদেশ ও বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন উচ্চতার পথে এগোবে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রীর পৌনে চারশ সফরসঙ্গীর মধ্যে ব্যবসায়ী আছেন ২৩৯ জন। এই প্রতিনিধি দলে থাকা বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সঙ্গে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে বৈঠকে বসবেন ভারতের টাটা, বিরলা, রিলায়েন্স, আদানী, পিরামলের মতো সর্ববৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। এ প্রসঙ্গে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সবখানেই প্রতিবেশীর সঙ্গে ব্যবসা ভালো হয়। ব্যবসার খরচও কম লাগে। এ সফরে ভারত আমাদের সহনীয় সুদে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার শুধু ঋণ দেবে না, দুই দেশের সম্পর্কও নতুন উচ্চতায় নেবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশকে ৪ হাজার ৭৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পাহাড়সম বাণিজ্য ঘাটতি অনেকটা পুষিয়ে দিতে এ সফরের সময় বেশ কিছু বড় বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব আসছে ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকার ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। তারই অংশ হিসেবে ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-ফিকিসহ ভারতীয় ব্যবসায়ীদের তিনটি শীর্ষ সংগঠনের সঙ্গে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের একটা বড় বৈঠক হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সঙ্গে আরেকটি বিশেষ বৈঠকে বসবেন ভারতীয় শিল্পোদ্যোক্তারা। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করবেন বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য। তারই আলোকে বাংলাদেশের পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর এবং রেল ও বিদ্যুৎ খাতে ভারতীয় বিনিয়োগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।  এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলের প্রধান ও এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে নতুন যে মোড় নেবে, সেটা হলো— চীনের মতো ভারতও এখন বেশি বেশি বাংলাদেশে বিনিয়োগের আশ্বাস দেবে। ভারত এখন আমাদের সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে বেশি বেশি ঋণ দেবে। এই ঋণ আমাদের দেশের অনেক উপকারে আসবে। বাংলাদেশের মেঘা উন্নয়ন প্রকল্পে ভারত খুব দ্রুত অংশ নিতে চায়। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত যে আগ্রহী তারই প্রকাশ ঘটবে এই সফরে। তাদের প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়নের দিকেও বেশি জোর দেবে ভারত।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ আছে। ভারত আমাদের শূন্য শুল্কের সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু আমরা সব পণ্য রপ্তানি করতে পারি না। আবার ভারত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সাড়ে ৪শ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে। এক্ষেত্রে ভারতের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারলেই ভালো। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে বিনিয়োগ পাওয়া সম্ভব। সে ভারতীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে সুবিধা পেতে পারে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ভারতের বাজারে মাত্র ৬৮৯ দশমিক ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির বিপরীতে বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আমদানি করা হয়েছে ৫ হাজার ৪৫০ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। এতে বাংলাদেশের পাহাড়সম বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৭৬১ মিলিয়ন। তবে এই বাণিজ্য ঘাটতি স্বাধীনতার পর দুই দেশের বাণিজ্য আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের শুরু থেকেই। অর্থাৎ বিগত ৪৬ বছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রতিবছর বেড়েই চলছে। আবার প্রতিবছর রপ্তানিও বেড়েছে দুই দেশের।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দিন যত যাবে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ততই বাড়বে। কারণ প্রতিবেশী এই দেশটির অনেক পণ্য আমদানির ওপর বাংলাদেশ অনেকটা নির্ভরশীল। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি খুব একটা কমবে না। তবে ভারতীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর একটা সুযোগ বাংলাদেশের আছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য ভারতসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানির সুযোগ আছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে দুই দেশ। এতে উভয়ই ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হবেন। 

দুই দেশের বাণিজ্য নিয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের এক সভায় ভারতের রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি ২০০১ থেকে এখন পর্যন্ত ৬ গুণ বেড়েছে। দুই দেশেরই রপ্তানি বাড়ছে। তার মতে, বাংলাদেশে মানসম্মত উৎপাদনমুখী শিল্প গড়ে উঠেছে। কিছু কোম্পানি ভারতে বিনিয়োগের সক্ষমতা অর্জন করেছে। ভারতের বড় বড় কিছু কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণও করেছে।

শীর্ষ বৈঠকে কানেকটিভিটিতে জোর দেবে বাংলাদেশ : আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ বা কানেকটিভিটিকেই জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে নেওয়া কিছু উদ্যোগ আটকে থাকায় নতুন ব্যবস্থার দিকেও আগ্রহী বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ভারতকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে চায় বাংলাদেশ। আগামী ৮ এপ্রিল দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে কানেকটিভিটির নতুন নতুন ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা। বৈঠকের পর শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে উদ্বোধন করবেন বেশ কয়েকটি কানেকটিভিটির প্রকল্প। সূত্রমতে, শীর্ষ বৈঠকের কানেকটিভিটি বিষয়ক এজেন্ডাই বেশি। এর মধ্যে কিছু নতুন নতুন ধারণার কথাও আছে। যেমন- বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার- চার দেশের মধ্যে বিসিআইএম-ইসি ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কায় উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মধ্যে অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তোলা যায় কি-না তা নিয়ে নতুন প্রস্তাব বিবেচনা করছে বাংলাদেশ। ভারতকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলবে বাংলাদেশ। একইভাবে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে চার দেশীয় মোটরযান চলাচল বিষয়েও আলোচনা করবেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নতুন প্রস্তাব হবে আপাতত ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে মোটরযান চালানোর। দুই বছর আগে এ নিয়ে চার দেশ চুক্তি সই করলেও ভুটানের অভ্যন্তরীণ কারণে যান চলাচল শুরু হয়নি। তাই ভুটানকে বাদ দিয়ে তিন দেশ নিজেদের মধ্যে যান চলাচল শুরু করতে পারে কি না, তা নিয়ে আলোচনা করবেন দুই প্রধানমন্ত্রী। প্রয়োজনে চুক্তিতে পরিবর্তন আনার বিষয়েও কথা বলবেন তারা।

সর্বশেষ খবর