শনিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভারতের সঙ্গে তিস্তাই একমাত্র সমস্যা নয়

শিমুল মাহমুদ

ভারতের সঙ্গে তিস্তাই একমাত্র সমস্যা নয়

আলী রীয়াজ

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ মনে করেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি চুক্তিই বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি শুধু তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ওপরই নির্ভরশীল নয়। ভারতের সঙ্গে অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদীর পানিবণ্টন নিয়েই আলোচনা হওয়া উচিত। গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির শর্তও প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা সে প্রশ্ন তোলেন তিনি। ড. আলী রীয়াজ বলেন, প্রতিবেশীদের ন্যায্য পাওনার ব্যাপারে ভারত সংবেদনশীল নয়। অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল সকালে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত  সাক্ষাৎকালে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিঃসন্দেহে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গোটা এশিয়াতেই শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নতুন সমীকরণে পৌঁছেছে। সেই প্রেক্ষাপটে ভারত অনেক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। বাংলাদেশ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভূ-রাজনৈতিক কারণে গুরুত্ব বহন করে। তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয় ধরলে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। গঙ্গাচুক্তির সবদিক প্রতিপালিত হচ্ছে বলে পানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন না। দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য বৈষম্য প্রবল। সীমান্তের একটা বড় অংশ কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। নিয়মিতভাবে সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা করা হচ্ছে। ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের রেমিট্যান্স আয়ের ষষ্ঠ বা সপ্তম খাত। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের এই বিশ্লেষক বলেন, ভারত যতটা আমাদের দেয়, নেয় তার চেয়েও বেশি। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় সমস্যাগুলো আলোচিত হওয়াটা খুব জরুরি। তিস্তাকে একমাত্র বিষয়ে পরিণত করা হচ্ছে কেন! আমি মনে করি, বাংলাদেশ যে ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে, তাতে তিস্তা চুক্তি হলেই কী অন্য সব বিষয় বাদ দিতে হবে? আগামী দুবছরের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চলতি সফরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি দুদেশের আগামী নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখবে কিনা জানতে চাইলে ড. আলী রীয়াজ বলেন, ভারতের নির্বাচন ও বাংলাদেশের নির্বাচন তুলনীয় নয়। ভারতের নির্বাচন নিয়ে পূর্বাভাস দেওয়া যায় যে, নির্বাচন কখন হবে, সুষ্ঠু হবে কিনা। কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে সেটা বলা যায় না। ভারতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের প্রভাব নির্বাচনে পড়বে না। ভারতের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার কথা। বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন নির্ভর করবে তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ওপর। রুটি রুজির প্রশ্ন নিয়ে প্রভাবিত হবে নির্বাচন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরে বাংলাদেশের ন্যায্য প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনাটা হলে কীভাবে দুদেশের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনা যায়, সেটার পথ খুঁজে পাওয়া যেত। ঢাকায় সদ্য অনুষ্ঠিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন-আইপিইউ সম্মেলন প্রসঙ্গে ড. রীয়াজ বলেন, কোনো ধরনের বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন হওয়া দেশের জন্য গৌরবের। তবে আইপিইউ কতটা কার্যকর সংগঠন সেটা দেখতে হবে। এর সিম্বলিক ভ্যালু আছে। সরকারের জন্য, দেশের জন্য ভালো। তবে প্রাপ্তিটা কী? বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে সহিংস উগ্রপন্থা নতুন নয়, এটা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। এখন নতুন মাত্রা দেখতে পাচ্ছি। কিছু কিছু বিষয় থাকে যেগুলো জঙ্গিবাদের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। যদি অনুকূল পরিবেশ না থাকে তাহলে জঙ্গিবাদের চালিকাশক্তিগুলো বেশিদূর যেতে পারে না। ড. আলী রীয়াজ বলেন, পৃথিবীর মুসলিম জনগোষ্ঠীগুলো মনে করে, তারা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এর প্রমাণও রয়েছে। তারা সেটাকে সম্পৃক্ত করে সহিংসতার পথ খুঁজে নেয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল একটি চমৎকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, সমাজে দুর্নীতি ও সহিংসতা জঙ্গিবাদ বিকাশের মূল কারণ। সমাজে ও রাজনীতিতে অন্যায্য পরিস্থিতি থাকলে সেটা জঙ্গিবাদ উসকে দেয়। অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও বলেন, জঙ্গিবাদ আসলে আদর্শিক ব্যাপার। ষাট, সত্তর দশকেও আমরা দেখতাম নেতারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে ঘনিষ্ঠ হয়ে তাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতেন। কিন্তু আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ হতে এখন আর ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রয়োজন পড়ে না। বৈশ্বিকভাবে নানা ধরনের উপকরণ আপনার হাতের নাগালে চলে আসছে। জনমতকে প্রভাবিত করছে। তিনি বলেন, দেশের ভিতরে জঙ্গিবাদ বিকাশের পথ বন্ধ করতে হবে। সেনা ও প্রশাসনিক অভিযান থাকবে। তার পাশাপাশি আদর্শিকভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করতে হবে। দুর্নীতি, বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতাবোধ দূর করতে হবে। বর্তমানে বিশ্বজুড়েই উগ্র-জাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থিদের উত্থান ঘটছে। আমেরিকায় ট্রাম্পের উত্থানও সেরকম। ভারতের বিজেপির উত্থানও সেরকম। জঙ্গিবাদ উগ্রপন্থা নির্মূল করা যায় না। এটাকে প্রশমিত করা যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে ড. আলী রীয়াজ বলেন, বিবেচনায় বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে হয় না। আমার এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কের ওপর নির্ভর করবে। চীনকে মোকাবিলা করার উপায় উপকরণ যেভাবে তারা নেবে তার ওপর বাংলাদেশ পড়বে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তার বড় উদাহরণ। তখন চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো ছিল, রাশিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য। সে জন্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ গুরুত্ব পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বীকার করে তাদের সে সময়ের ভুলটা। ১৯৭১ সালে তাদের অবস্থান যে ভুল ছিল, বর্তমান বাংলাদেশই তার বড় প্রমাণ। একাত্তরের পর দীর্ঘ সময়েও বাংলাদেশ টিকে আছে এবং প্রবলভাবে বিকশিত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর