শিরোনাম
রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঢাকা-দিল্লি ৬ চুক্তি ১৬ সমঝোতা

উন্নয়নে ৪৫০ কোটি, সামরিক কেনাকাটায় ৫০০ কোটি ডলার, কানেকটিভিটির নতুন উদ্যোগ

জুলকার নাইন ও রফিকুল ইসলাম রনি, নয়াদিল্লি থেকে

ঢাকা-দিল্লি ৬ চুক্তি ১৬ সমঝোতা

নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে গতকাল বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয় —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে রাজধানী নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ ভবনে এই ৬ চুক্তি ও ১৬ সমঝোতা স্মারকপত্র সই হয়।

তবে দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে ৩৪টি দলিল সইয়ের কথা জানানো হয়। পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক ৩৬টি দলিল সই হয়েছে বলে জানালেও কোনো তালিকা তিনি দিতে পারেননি।

বহুল আলোচিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না হলেও সামরিক সহযোগিতাবিষয়ক ৫টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিট হিসেবে নতুন করে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ভারত। সেই সঙ্গে সামরিক খাতের কেনাকাটায় আরও ৫০০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষায়, বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক সোনালি অধ্যায় শুরু হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুই দেশের এই নবযাত্রায় উন্নত হবে পুরো দক্ষিণ এশিয়া। জানা যায়, সফরের দ্বিতীয় দিনে সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরু হয়। পরে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি চলে আসেন হায়দরাবাদ হাউসে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী একান্তে কথা বলেন কিছুক্ষণ। এরপর শুরু হয় আনুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠক। বৈঠক শেষেই শুরু হয় সমঝোতা স্মারকপত্র স্বাক্ষর। এর মধ্যে ‘সামরিক সহযোগিতা রূপরেখা’বিষয়ক সমঝোতা স্মারকে সই দেন ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার। ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, ঢাকা ও ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, নয়াদিল্লি’-এর মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা ও উন্নয়নবিষয়ক সমঝেতা স্মারকেও তারা স্বাক্ষর করেন। ‘মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’বিষয়ক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন ভারতের মহাকাশ বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশের বিটিআরসি চেয়ারম্যান। নিউক্লিয়ার এনার্জির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার বিষয়ে চুক্তিতে সই দিয়েছেন ভারতের পারমাণবিক শক্তি বিভাগের সচিব অ্যাটমিক এনার্জি সেক্রেটারি ও বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব। পারমাণবিক নিরাপত্তা ও ক্ষতিকর রশ্মি প্রতিরোধে ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড ও বাংলাদেশের অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের মধ্যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ভারতের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি সেক্রেটারি ও বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব। বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সহযোগিতাবিষয়ক ভারতের পারমাণবিক শক্তি বিভাগ ও বাংলাদেশের আণবিক শক্তি কমিশন ও গ্লোবাল সেন্টার ফর পার্টনারশিপ (জিসিএনইপি)-এর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ভারতের জিসিএনইপি চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান। ভারতের ইলেকট্রনিক্স ও ইনফরমেশন মন্ত্রণালয়ের এবং বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতার সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও বাংলাদেশের আইসিটি সচিব। সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও বাংলাদেশের আইসিটি সচিব। আরও সীমান্ত স্থাপনবিষয়ক সমঝোতা স্মারকে সই করেন দুই দেশের বাণিজ্য সচিব। বাংলাদেশ ও ভারতের বিচার বিভাগের সহযোগিতাবিষয়ক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী। বাংলাদেশি বিচারকদের ভারতে প্রশিক্ষণ বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে সই দেন ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমির পরিচালক ও বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার। জাহাজ চলাচলবিষয়ক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন ভারতের লাইট হাউস ও লাইটশিপস মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশের শিপিং বিভাগের মহাপরিচালক। ভূতত্ত্ব গবেষণার ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারকে সই দেন উভয় দেশের জিওলজিক্যাল সার্ভের মহাপরিচালক। ক্রজ সার্ভিসবিষয়ক সমঝোতা স্মারকে সই করেন দুই দেশের নৌপরিবহন সচিব। ভারত-বাংলাদেশ প্রটোকল রুটে সিরাজগঞ্জ থেকে লালমনিরহাটের দইখাওয়া এবং আশুগঞ্জ থেকে জকিগঞ্জ পর্যন্ত নাব্য চ্যানেলের উন্নয়নে সমঝোতা স্মারক দুটিতে সই করেন দুই দেশের নৌপরিবহনমন্ত্রী। গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ও ভারতের তথ্য সচিব স্বাক্ষর করেন। অডিও-ভিজুয়াল সহ-প্রযোজনা চুক্তিতেও তারা দুজন সই করেছেন। ৫০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা ঋণসহায়তা সমঝোতা স্মারকে বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সই করেন। মোটরযান যাত্রী চলাচল (খুলনা-কলকাতা রুট) নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি ও চুক্তির স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরসে দুই দেশে সড়ক বিভাগের সচিব স্বাক্ষর করেন। তৃতীয় ঋণসহায়তার আওতায় বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সই দেন। বাংলাদেশে ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণে অর্থায়নের চুক্তিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার সই করেন। সাড়ে ৪০০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা, মহাকাশ গবেষণা এবং যাত্রীবাহী নৌ চলাচলে স্বাক্ষরিত সমঝোতাপত্রগুলো গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে বিনিময় করা হয়। সেখানেই উন্মোচন করা হয় হিন্দি ভাষায় অনূদিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী। উপস্থিত থাকা মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে যৌথভাবে দুই প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন বিরল-রাধিকাপুর রুটে মালামাল পরিবহনকারী রেল চলাচল, খুলনা-কলকাতা রুটে যাত্রীবাহী বাস ও রেল চলাচল। একই সময়ে ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রক্রিয়ার উদ্বোধন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার সঙ্গে মোদির ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিতে আমরা রাজি হয়েছি। তিস্তা চুক্তি, গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ, পানি ব্যবস্থাপনার সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে আমাদের। পরে নরেন্দ্র মোদি বলেন, সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র দুই দেশের জনগণ বিশেষ করে তরুণদের মধ্যকার বন্ধনকে আরও জোরাল করবে। ভারত সব সময় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীলতা নীতি ভারতের কাছে অনুপ্রেরণা। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ (লাইন অব কনসেশনাল ক্রেডিট বা নমনীয় শর্তে ধারাবাহিক ঋণ) দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর বাইরে ৫০০ কোটি ডলার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় সামরিক খাতে। মোদি বলেন, এটা বাংলাদেশের চাহিদার ভিত্তিতে দেওয়া হবে। শীর্ষ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, উপদেষ্টা মশিউর রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক, নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী প্রমুখ। ভারতের পক্ষে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, শিল্প প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়সহ অন্যরা।

গার্ড অব অনারে দিনের শুরু : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সকালে রাষ্ট্রপতি ভবন প্রাঙ্গণে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি ভবনের সংবর্ধনাস্থলে স্থানীয় সময় ৯টা ১৫ মিনিটে এসে পৌঁছলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাকে স্বাগত জানান। প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্টের একটি অশ্বারোহী দল রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রধান গেট থেকে সংবর্ধনাস্থল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরকে এগিয়ে নিয়ে যায়। পরে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার দেয়। এ সময় দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেঁটে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন এবং সালাম গ্রহণ করেন। গার্ড পরিদর্শন শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেখানে উপস্থিত তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সফরসঙ্গী মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দেন। ভারতের পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী রাম কৃপাল যাদব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হংসরাজ, বিদ্যুত্মন্ত্রী পীযূষ গয়াল, জ্বালানি ও প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদ সম্পর্কিত মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান, ভারী শিল্প ও পাবলিক এন্টারপ্রাইজবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়, ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত এবং দিল্লির গভর্নর অনিল বাইজাল এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যমুনার তীরে রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং ভারতের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার আন্দোলনের মহান নেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেন এবং পরিদর্শন বইয়ে সই করেন। সন্ধ্যায় ৬ আজাদ এভিনিউতে ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ হামিদ আনসারির সঙ্গে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সর্বশেষ খবর