সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

তিস্তা নিয়ে কী হবে

সম্পর্কের কাঁটা মমতা, এখনো আশাবাদ কূটনীতিবিদদের

জুলকার নাইন ও রফিকুল ইসলাম রনি, নয়াদিল্লি থেকে

তিস্তা নিয়ে কী হবে

ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে গতকাল প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

তিস্তা নিয়ে দিল্লি আসার কথা ছিল না পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী সবকিছু করতে চান স্বাভাবিক গতিতে। এ কারণে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মতো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও মমতাকে আমন্ত্রণ জানান দিল্লিতে। রাষ্ট্রপতির বাড়িতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাদা বৈঠক হয় মমতা ব্যানার্জির। মূল আলোচনাই ছিল তিস্তা। মমতা তিস্তার বিকল্প অন্য চারটি নদীতে পানি দেওয়ার প্রস্তাবও দেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ছিলেন তার অবস্থানে অনড়। শেখ হাসিনার কঠোর মনোভাবের কারণেই মমতার মন গলাতে ব্যস্ত ছিল দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার। নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, শেখ হাসিনার চলমান সফরে তিস্তা চুক্তির প্রস্তুতি কোনো পক্ষেরই ছিল না। তবে তিস্তা চুক্তি এ বছরের মধ্যে করার আশ্বাস পাওয়া গেছে। মমতা ব্যানার্জিও আগের মতো কঠোর অবস্থানে নেই। তার কথার সুর অনেকটাই নমনীয়। যদিও তিনি অনেক বিকল্পের কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে মমতা প্রথম থেকেই এ চুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথার সুরে স্পষ্টতা ছিল, তিনি তার মেয়াদের মধ্যেই তিস্তাবিরোধ শেষ করতে চান। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানিয়ে নজির স্থাপন করেছেন। এ কারণে তাকে ভারতের কিছু মিডিয়ার কটাক্ষও শুনতে হয়েছে। কিন্তু তার আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না বাংলাদেশ নিয়ে। একইভাবে আশার আলো তৈরির জন্য কাজ করেছেন বাংলাদেশের বন্ধু ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ পানি পাক তা আমিও চাই। কিন্তু তিস্তা থেকে দেওয়ার উপায় আমার নেই। আমি বলেছিলাম যে আমরা যদি একটু ভেবে দেখি, তিস্তায় যখন আমার সমস্যা হচ্ছে, আর তিস্তাতে যেহেতু আমার গজলডোবা ব্যারাজ আছে, আমার পানির সমস্যা আছে, ড্রিংকিং ওয়াটার, ফারমারস নানা সমস্যা আছে, এই হিসেবে আমি তিন-চারটি নদীর নামও বলে গেছি।’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, তোরসা, মানসাই, ধানসাই ও ধরলার মতো কয়েকটি ছোট নদী আছে, যেগুলো বাংলাদেশে গিয়ে মিশেছে। যৌথ সমীক্ষা করে যদি সেসব নদী থেকে বাংলাদেশকে পানি দেওয়ার সুযোগ থাকে, তাহলে তিনি তাতে রাজি আছেন। কূটনীতিকরা বলছেন, কিছুদিন আগেও মমতার এমন সুর ছিল না। সূত্রের খবর, তিস্তা চুক্তি নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যেই মমতা ব্যানার্জিকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে নয়াদিল্লিতে ডাকা হয়। তাকে সঙ্গে নিয়েই শনিবার দুপুরে মধ্যাহ্নভোজে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে খানিকটা হাস্যরসও করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মমতাকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হঠাৎ করে তুমি আমাকে আপনি বলে ডাকছ কেন? আগে তো তুমিই বলতে।’ মমতা জবাবে বলেন, ‘অন্যদের সামনে এভাবে তুমি বলা ঠিক হবে কি না তা বুঝতে পারিনি।’ এর পরই মোদির উদ্দেশে মমতা বলেন, ‘আসলেই তিস্তা থেকে পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। শুধু সেচ নয়, খাবার পানিরও সমস্যা হবে। তাই শুধু তিস্তার ওপরই কেন নজর সীমাবদ্ধ রাখা হবে? অন্য অনেক নদীই আছে, যেগুলো ভারত থেকে বাংলাদেশে গিয়ে মিশেছে। সেই নদীগুলো থেকে কীভাবে শুষ্ক মৌসুমে দুই দেশ পানি পেতে পারে তা স্টাডি করা যায়।’ এ সময় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও বাংলাদেশ সরকারকে খুশি রাখার চেষ্টা করতে নতুন আরেকটি কথা তোলেন মমতা ব্যানার্জি। তিনি শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির উদ্দেশে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যাতে ভুল না বোঝেন, সে জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠানো যায়। এক হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে দিতে পারে পশ্চিমবঙ্গ।’ বিদ্যুৎ নিয়ে মমতা ব্যানার্জির এ প্রস্তাবের কথা শুনে মোদি লিখিতভাবে তা জানানোর কথা বলেন। পরে নয়াদিল্লিতে বসে বিকালেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত প্রস্তাব লিখে জমা দিয়ে দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। এতেই শেষ হয়নি, রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মমতা ব্যানার্জিকে ডাকেন নৈশভোজে। দুজনের এ নৈশভোজে অংশ নিতে উপহারসামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হন মমতা ব্যানার্জি। ওই নৈশভোজে এবং পরে বেশ লম্বা সময় ধরে কথা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূণ কংগ্রেস নেতা মমতার। সেখানে মমতা আরও বিস্তারিত নিজের বিকল্প প্রস্তাবের কথা তুলে ধরেন। বারবার চেষ্টা করেন শেখ হাসিনাকে বোঝাতে। পরে সেখান থেকে বের হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়াগুলোর প্রতিনিধিদের কাছে নিজের বিকল্প প্রস্তাবের কথা তুলে ধরেন মমতা। অবশ্য একই ইস্যুতে গতকাল রাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গেও কথা বলতে হয়েছে মমতা ব্যানার্জিকে। নয়াদিল্লিতে অবস্থান করা বাংলাদেশের শীর্ষ কূটনীতিকদের একজন বলেন, মমতা ব্যানার্জির এ মন্তব্যকে কোনোভাবেই বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে দেখছে না বাংলাদেশ। কারণ আগেই দুই দেশের মধ্যে খসড়া চূড়ান্ত হয়ে আছে এবং সে খসড়া অনুসারেই চুক্তি করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত বিভিন্ন সময় প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। তাই সেই সমবণ্টনের খসড়া ছাড়া অন্য কোনো চুক্তিতে বাংলাদেশ রাজি হবে না বলেও জানান এ কূটনীতিক। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ ঘোষণাতেও তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ এসেছে। এতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে ২০১১ সালে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক দ্রুত তা সম্পাদনের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করেছেন। মোদি তার দেশের সব অংশীদারের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত চুক্তি সই করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দুই প্রধানমন্ত্রী ফেনী, মনু, খোয়াই, মুহুরী, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি ভাগাভাগির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা শেষ করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে পদ্মা নদীর ওপর গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের লক্ষ্যে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়াকে স্বাগত জানান দুই প্রধানমন্ত্রী। তারা গঙ্গা ব্যারাজের জন্য যৌথ কারিগরি দলের পরিদর্শনের পর এ ব্যাপারে যৌথ কারিগরি উপকমিটি গঠনকে ইতিবাচক হিসেবে অভিহিত করেন। সংশ্লিষ্টদের এ প্রকল্প এগিয়ে নিতে কাজ করার নির্দেশও দিয়েছেন তারা। হায়দরাবাদ হাউসে শনিবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতির সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিস্তার মতো অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টন, পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প ও অভিন্ন নদ-নদীর অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনাসহ পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি, এসব ইস্যু দ্রুত সমাধানে আমরা ভারতের সহযোগিতা পাব।’ তিস্তা চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘আমি আপনাকে ও বাংলাদেশের জনগণকে আমাদের অঙ্গীকার এবং চলমান প্রচেষ্টার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিচ্ছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কেবল আমার সরকার এবং মাননীয় শেখ হাসিনা, আপনার সরকার তিস্তার পানি বণ্টনে দ্রুত সমাধান খুঁজে পেতে পারে এবং পাবে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর