মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাঞ্চল্যকর তদন্ত রিপোর্ট

সাউথ বাংলা ব্যাংক কাহিনী

৫৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ, কোম্পানি গঠনের দুই মাসের মধ্যে ঋণ, বিদেশে ১৮ কোটি টাকা পাচার

আলী রিয়াজ

সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে ৫৭ কোটি ২০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেড নামে কোম্পানি গঠনের দুই মাসের মধ্যে নিজের ব্যাংকে প্রভাব খাটিয়ে তিনি এই ঋণ নিয়েছেন। মোট ঋণের ১০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা নিয়েছেন বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই। ঋণের মর্টগেজের জমি ১৪ গুণ বেশি দর দেখানো হয়েছে আলোচিত ঋণটিতে। প্রকল্পের জন্য মেশিনারিজ ক্রয়ে এলসিতে জালিয়াতি করা হয়েছে। এমনকি এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে বিদেশে ১৮ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের খুলনা কার্যালয়ের তদন্তে উঠে এসেছে। ব্যাংকটিতে তদন্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা এই ঋণ হিসাবের সব অনিয়ম চিহ্নিত করে প্রধান কার্যালয়ের কাছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে লাইসেন্স নেয় মেসার্স আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেড। মো. আরজান আলী ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে দেখানো হয় আমজাদ হোসেনের মেঝো ভাই মো. রুহুল কুদ্দুসের ১৯ বছরের মেয়ে মাহফুজা খাতুন রিশাকে। এই কোম্পানির ৭৫ শতাংশ শেয়ারধারী রিশা ও এমডি আরজান আলী ২৫ শতাংশ শেয়ারধারী। পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কোম্পানির প্রকল্প কাজের জন্য প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ব্যতীত তাইওয়ান ও চীন থেকে ২৩ জুন মোট প্রায় ১৮ কোটি টাকার এলসি স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে কোনোটার ইনভয়েসে এইচএস কোড নেই, কোনোটার ইউনিট প্রাইজ নেই। এ ছাড়া আমদানি তালিকায় যে মূল্য দেখানো হয়েছে তার দাম সঠিক কিনা সে বিষয়ে কোনো প্রমাণ দেখানো হয়নি। এই অর্থ পুরোটাই পাচার করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ২০ মার্চ ৫ শতাংশ মার্জিনে মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানির উদ্দেশ্যে ১৫ কোটি ৮ লাখ টাকার এলসি স্থাপনের অনুমোদন দেয়। কিন্তু অতিরিক্ত ২ কোটি টাকা অনুমোদনহীন এলসি স্থাপন করা হয়েছে যা গুরুতর অনিয়ম।

কোম্পানি ও ঋণ অনুমোদনের চিত্রে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নতুন গঠিত একটি কোম্পানিকে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ আবেদন ও অনুমোদনে দেখা যায়, ১৫ ফেব্রুয়ারি সাউথ বাংলা ব্যাংকের বাগেরহাটের কাটাখালী শাখায় মেসার্স আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেডের নামে একটি হিসাব খোলা হয়। যার হিসাব নম্বর ০১১১১০০০১২৬৮৭০। ঋণ আবেদন করা হয় ১ মার্চ। ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক বিধান কুমার সাহা কোম্পানি পরিদর্শনপূর্বক একটি রিপোর্ট দেন। ওই রিপোর্টে আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেড ৩০ শতাংশ সিভিল ওয়ার্ক সম্পাদন করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। ৮ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা কম্পোজিট লিমিট মঞ্জুরির জন্য ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ঋণ বিভাগে সুপারিশ করা হয়। প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট প্রোফাইল পরীক্ষা করে দেখা যায়, প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২১২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে কোম্পানির ভূমি উন্নয়ন বাবদ ২৭ কোটি ২০ লাখ টাকা, ভবন নির্মাণ ব্যয় ৫৪ কোটি ১২ লাখ টাকা, মেশিনারিজ ও ইকুইপমেন্টের জন্য ১২৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা, আইডিপিপি সুদ পরিশোধ বাবদ ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং বিবিধ খরচ বাবদ ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকার ঋণ প্রস্তাব করা হয়। ঋণ বিভাগের ১৫ মার্চ ১৪৪৮/৪৫ নম্বর মেমোর মাধ্যমে ৩৯ নম্বর এজেন্ডায় ঋণ হিসাবটি ব্যাংকের ৪৫তম সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত হয়। পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে কারখানা ভবন নির্মাণে ১৮ কোটি এবং এলসির ইনার লিমিট ১৫ কোটি টাকা ফান্ডেড ঋণ এবং মেশিনারিজ আমদানি বাবদ ১৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা নন-ফান্ডেড সব মিলিয়ে ৪৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়।

রিপোর্টে দেখা গেছে, কারখানা ভবন নির্মাণে ১৮ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর থাকলেও ৩০ জুন সময় শেষে দেখা গেছে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়া আরও ৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ১ মার্চ ঋণ আবেদনের সময় হতে ৩০ জুন সময় পর্যন্ত মোট ৫৭ কোটি ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

২০ মার্চ  প্রধান কার্যালয়ের এসবিএসি/ এইচও/ক্রেডিট/২০১৬/৮৪০ নম্বরপত্রে ব্যাংক শাখাকে অতিবাহিত করা হয়। চার্জ ডকুমেন্টসমূহ যথাযথ পূরণ না করে ২৩ মার্চ তারিখেই ঋণ হিসাবে উত্তোলনের সুবিধা প্রদান করা হয়। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, এ অর্থ ওই দিনেই ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের চলতি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। প্রতিষ্ঠানের ০১১১১০০০১২৬৮৭০ নম্বর চলতি হিসাব থেকে উক্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান লকপুর গ্রুপের বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।  রিপোর্টটি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১ মার্চ তারিখে ঋণ আবেদনের প্রাপ্তির একদিন পর ৩ মার্চ প্রকল্পের চলমান কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন, ঋণ আবেদনপত্র দাখিলের মাত্র ৪ কার্যদিবসের মধ্যে উপস্থাপিত দালিলিক কাগজপত্র পরীক্ষণ, সাইট পরিদর্শনপূর্বক ভূমি উন্নয়ন, বিভিন্ন সংস্থাপন সংক্রান্ত তথ্যাদি যাচাই, মালামাল আমদানি সংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষণপূর্বক নতুন প্রকল্পে ঋণ মঞ্জুর প্রস্তাব প্রেরণ অবিশ্বাস্যভাবে দ্রুত ও স্বল্পতম সময়ে প্রেরণ করা হয়েছে। ঋণ আবেদন দাখিলের মাত্র ২০ দিনের মধ্যে ঋণ মঞ্জুর করায় ঋণ মঞ্জুরি প্রক্রিয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কোম্পানি প্রোফাইলে বলা হয়, আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরজান আলীর ১০ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয় আরজান আলীর বয়স ৩৬ বছর। ২৬ বছর পর্যন্ত তিনি কোনো ব্যবসা করেননি। প্রতিবেদনের ৫.২ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত আরজান আলীর ব্যবসায়ের ধরন, প্রকৃতি, ব্যবসায়ের দায়-সম্পদ, আয়-ব্যয় বিবরণী, ভ্যাট ও আয়কর পরিশোধ সনদ ও সম্পদ বিবরণী সংক্রান্ত কোনো তথ্যই শাখা থেকে সংগ্রহ বা পরীক্ষা করা হয়নি। ওই কোম্পানির পরিচালক মাহফুজা খানম রিশার ব্যবসা সংশ্লিষ্ট কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রমাণ বহন করে না। রিশার বর্তমান বয়স মাত্র ১৯ বছর এবং পেশায় তিনি একজন ছাত্রী। কাজেই তার ব্যবসা সংশ্লিষ্ট পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ধরনের বিপুল পরিমাণ ঋণ প্রস্তাব বিবেচনা বা অনুমোদন ও বিতরণের পূর্বে উল্লিখিত দালিলিক প্রমাণাদি সংগ্রহ ব্যতিরেকে শেয়ারহোল্ডারদের সামর্থ্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই ব্যতিরেকে বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করে শাখাটিকে বড় ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন করা হয়েছে। চিংড়ি প্রসেসিং ফ্যাক্টরি ও রপ্তানি ব্যবসা প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ২৫ শতাংশ কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্ন  করা হয়েছে, অবশিষ্ট কাজ দ্রুত করার জন্য চলমান রয়েছে বলে প্রত্যয়ন করা হয়েছে। ২৫ শতাংশ সম্পন্ন হলেও ১৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক যথাক্রমে চাকরিজীবী ও ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে নিজস্ব উৎস থেকে ব্যয় করলেন এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক হলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে প্রভাবিত হয়ে উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই শাখা ব্যবস্থাপনা ঋণ প্রস্তাব করেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

রিপোর্টে দেখা যায়, প্রকল্পটি বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের কাটাখালী-মংলা মহাসড়কে অবস্থিত। রিশার নামে ফকিরহাটের নওয়াপাড়া মৌজার বিভিন্ন দাগে ৩২০ শতক জমি ব্যাংক শাখার অনুকূলে বন্ধককৃত। শাখা ব্যবস্থাপক কর্তৃক ৬ মার্চ প্রতি শতক জমির মূল্য সাড়ে ৮ লাখ টাকা ধরে ৩২০ শতক জমির দাম ২৭ কোটি ২০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তাত্ক্ষণিক বিক্রয়ের ক্ষেত্রে শতক প্রতি ৭ লাখ ২২ হাজার ৫০০ টাকা ধরা হয় ফলে এর মোট মূল্য দাঁড়ায় ২৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। কিন্তু ২০১৫ সালের মৌজাওয়ারি রেট পরীক্ষান্তে দেখা যায়, প্রতি শতক জমির বাণিজ্যিক মূল্য মাত্র ৬০ হাজার টাকা। সে হিসেবে মর্টগেজ হিসেবে বন্ধক রাখা জমির মূল্য পড়ে ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অবস্থানগত বিবেচনায় সম্পত্তির মূল্য সরকারি মৌজাওয়ারি রেট থেকে ১৩/১৪ গুণ বেশি ধরে সম্পত্তির মূল্যায়ন করা হয়েছে। জানতে চাইলে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও লকপুর গ্রুপের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড এগ্রো এক্সপোর্ট বাংলাদেশের একটি পাইওনিয়ার প্রতিষ্ঠান হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে এই প্রথম উন্নত মানের খাদ্য প্রস্তুত করে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হবে। কোম্পানিটি শতভাগ রপ্তানি সংশ্লিষ্ট শিল্প। এতে কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব। আমাদের ব্যাংকের কোনো খেলাপি ঋণ নেই। নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে গত বছর সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে এই ব্যাংক। এখানে কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই।

সর্বশেষ খবর