বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

পানি কেউ আটকে রাখতে পারবে না

দিল্লি সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

বিশেষ প্রতিনিধি

পানি কেউ আটকে রাখতে পারবে না

তিস্তার পানি আসবেই, তা কেউ আটকে রাখতে পারবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের নির্ধারিত মেয়াদেই তিস্তা চুক্তি হবে বলেও জানান তিনি। চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে গতকাল বিকালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় বাসভবন গণভবনে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকসহ গণমাধ্যমে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভারত সফর নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে ধরেন। লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী জানান, এই সফরে মোট ৩৫টি দলিল সই হয়েছে। এর মধ্যে চুক্তি হচ্ছে ১১টি ও ২৪টি সমঝোতা স্মারক।

এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনা কখনো দেশ বিক্রি করে না। দেশের স্বার্থ রক্ষা করে, মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করে। তিনি বলেন, ‘দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি অন্তত আমি করব না। এই গ্যারান্টি আমি জনগণকে দিতে পারি।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা ভুলে যান কেন, আমি জাতির পিতার কন্যা। আমার বাবাও কখনো দেশের স্বার্থ বিকিয়ে রাজনীতি করেননি। আমাদের রাজনীতি নিজের জন্য নয়। জনগণের জন্য।’

ভারত সফরের তৃপ্তি কতটুকু আর কোনো হতাশা আছে কিনা, একজন সিনিয়র সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সফরটা ফলপ্রসূ হয়েছে, সবটুকুই তৃপ্তির। হতাশার কিছু নেই। আমার আত্মবিশ্বাস প্রবল। হতাশাকে কখনো প্রশ্রয় দিই না। আমি যে সিদ্ধান্ত নিই, তা দৃঢ়চেতা হয়েই নিই। আমার লক্ষ্য ছিল আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তোলা, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা।’ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনে ভূমিকা রাখতে বিজেপির  এক সিনিয়র নেতার প্রস্তাবে সাড়া দেবেন কিনা, জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি চাই প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্ব থাকুক। এর জন্য কিছু প্রয়োজন হলে করব।’ প্রাপ্তির দিক থেকে ভারত না বাংলাদেশ এগিয়ে— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো কিছু চাইতে যাইনি। বন্ধুত্ব চাইতে গিয়েছিলাম বন্ধুত্ব পেয়েছি। বাংলাদেশের জনগণ পেয়েছে সম্মান। এটি আমার অর্জন।’ প্রধানমন্ত্রীর কাছে একজন সিনিয়র সাংবাদিক জানতে চান, ‘আপনি যে ভারসাম্যের পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রসর হচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনো ভয় পান কিনা?’ জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেখুন, বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিল সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। আমরাও এ নীতিতে বিশ্বাস করি। এ কারণেই ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে বলে আমার বিশ্বাস।’ তিনি বলেন, ‘নিয়ম ভালো থাকলে সবকিছু ভালো হবে এটাই স্বাভাবিক।’ সংবাদ সম্মেলনে তিস্তা চুক্তি ছাড়াও প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, পররাষ্ট্রনীতি, গঙ্গা ব্যারাজ, দুই দেশের ব্যাণিজিক সম্পর্ক বিষয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দুই পাশে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। সাংবাদিকরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলেও ঘুরেফিরে তিস্তা চুক্তি না হওয়া এবং বিরোধী দল কর্তৃক দেশবিরোধী চুক্তির অভিযোগ উঠে এসেছে বার বার। এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এ অভিযোগ যারা বেশি বেশি করেন, দেশবিরোধী চুক্তি তাদের পক্ষেই সম্ভব।’ এ প্রসঙ্গে বিএনপির শাসনামলে চীনের সঙ্গে গোপন চুক্তির বিষয়টি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘তিস্তার পানি নিয়ে এখন অনেকেই কথা বলেন। কিন্তু ভারত যখন গজলডোবায় বাঁধ দিল, তখন যারা ক্ষমতায় ছিল, তখন তো কেউ কথা বলেনি। পরে ওই নদীতে আমরা ব্যারাজ করলাম। এটাও ভুল ছিল। এর ফল এখন পাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেক সরকার এসেছে। অন্যরা কেউ তিস্তার পানি নিয়ে টুঁশব্দ করেনি। এমনকি সীমান্ত জটিলতার সমাধানেও কোনো সরকার ভারতকে চাপ দেয়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর জন্য জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়াকে জনগণের কাছে দায়ী থাকতে হবে। তিস্তার পানি প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিকল্প প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য কিনা, এ প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমিও বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছি। তাকে বলেছি, অন্য নদীর পানিগুলো আপনারা নিজেরা নিয়ে তিস্তার পানি আমাদের দিন। এটা নিয়ে আলোচনা চলবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা আলোচনা করছি। তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতা কিন্তু একেবারে “না” করেননি। আশপাশের নদীগুলো সংযোগ করে এটা করার কথা বলেছেন। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তিস্তা চুক্তি হবেই। তিনি (মোদি) ও আমি ক্ষমতায় থাকতে এটা হবে।’ দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক ও চুক্তিগুলো জনগণের সামনে প্রকাশ বা সংসদে আলোচনা হবে কিনা, জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে, সেগুলো নিয়ে লুকোছাপার কিছু নেই। তিনি বলেন, ‘আমি যতক্ষণ আছি, বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কিছু হবে না।’ সফর সম্পর্কে মূল্যায়ন জানতে চাওয়া হলে শেখ হাসিনা বলেন, সামগ্রিকভাবে এ সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন গতির সঞ্চার হয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতা-বিশ্বস্ততা-বন্ধুত্বের বহুমুখী সম্পর্ক এ সফরের মাধ্যমে আরও সুসংহত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘বিশেষ তাত্পর্য’ বহন করে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্ব অত্যন্ত সুদৃঢ় এবং বিবাদের মাধ্যমে কোনো কিছু অর্জন সম্ভব নয়।’ গঙ্গা সমীক্ষা হওয়া সত্ত্বেও এ নিয়ে এবারের সফরে ভারত সরকারের কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সমীক্ষা করে রাজবাড়ীর পাংশায় গঙ্গা ব্যারাজের যে নকশা তৈরি করেছে, তা বাস্তবায়ন করা ‘আত্মঘাতী’। এর বদলে উজানে ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে ‘রিজার্ভার’ তৈরি করে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহারের জন্য পানি সংরক্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির সময় আমি বলেছিলাম, ব্যারাজ একসঙ্গে করব, যাতে সবাই ব্যবহার করতে পারে। এটা ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে করতে হবে এবং খরচ ভারতও দেবে।’ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যারা পাংশায় ব্যারাজের নকশা করেছেন, তাদের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, প্রকল্প নিলে টাকা আসবে এবং সেখানে লাভের আশা থাকবে— এটাই অনেকের চিন্তা থাকে। ওই নকশা ‘পছন্দ হয়নি’ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে, রিজার্ভার যদি করা যায়, যাতে দুই দেশ শুষ্ক মৌসুমে তা ব্যবহার করতে পারে।’

শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, ‘মামলায় হেরে যান তিনি (ইউনূস), আর দোষ হয় আমার। তাদের ষড়যন্ত্র বহু আগের। আপনারা এত পরে জানছেন কেন?’

সর্বশেষ খবর