বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

হান্নানসহ ৩ জঙ্গির ফাঁসি

মির্জা মেহেদী তমাল, সাখাওয়াত কাওসার, শাহ্ দিদার আলম নবেল ও খায়রুল ইসলাম

হান্নানসহ ৩ জঙ্গির ফাঁসি

গাজীপুর কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের ফাঁসির মঞ্চ। এক মঞ্চেই পাশাপাশি দুটি কূপ। এর ওপর দুটি রশি ঝুলছে। চারপাশ ঘিরে কারারক্ষী। তারা সতর্ক অবস্থানে। কারা কর্মকর্তারাও ছোটাছুটি করছেন। কেউ কেউ মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন কারারক্ষীদের। আলোচিত জল্লাদ রাজু তার সহযোগী নিয়ে সেখানে প্রস্তুত। আরও ছয় জল্লাদ দুজনকে কনডেম্ড সেল থেকে নিয়ে আসছে। দুজনের মাথা কালো কাপড়ে ঢাকা। এদের একজন ভয়ঙ্কর জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, অন্যজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি শরীফ শাহেদুল বিপুল। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় নির্ধারিত সেই ফাঁসির মঞ্চে। পাশাপাশি দুই কূপের ওপর পাটাতনে দাঁড় করানো হয়। সব প্রক্রিয়া তখন সম্পন্ন। সুনসান নীরবতা। কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক মিজানুর রহমানের হাতে ধরে রাখা একটি রুমাল মাটিতে ফেললে জল্লাদ রাজু ফাঁসির মঞ্চের লিভার (লোহার তৈরি বিশেষ হাতল) টান দেন। ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন ঠিক ১০টা। দুজনের পায়ের নিচ থেকে কাঠের পাটাতন সরে যায়। ঝুলে পড়েন হান্নান ও বিপুল। কার্যকর হয় ফাঁসি।

গতকাল রাতে গাজীপুর কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে এভাবেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে জঙ্গিবাদের গডফাদারসহ দুই জঙ্গির। রাত ১০টা ১ মিনিটে আরেক জঙ্গি দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি এভাবেই কার্যকর হয় সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে কয়েদির সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের শেষ সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়। এ ফাঁসির রায় কার্যকরকে কেন্দ্র করে গাজীপুর আর সিলেট শুধু নয়, রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।

নিষিদ্ধ উগ্রপন্থি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি)-এর শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ তিনজনের ফাঁসির মধ্য দিয়ে এ পর্যন্ত ১০ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো।

গত রাতে ফাঁসির রায় কার্যকরের পর কাশিমপুর কারাগারের বাইরে এসে সিনিয়র জেল সুপার মিজানুর রহমান উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারের মসজিদ প্রাঙ্গণে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা ও তিনজন নিহত হওয়ার মামলার বিচারে দুই জঙ্গিকে রাত ১০টায় ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। চিকিৎসকরা তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন। কাশিমপুর কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে পাশাপাশি দুটি রশিতে আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল বিপুলের দণ্ড কার্যকর করা হয়। কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসির রায় কার্যকরের সময় আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, ডিআইজি প্রিজন তৌহিদুল ইসলাম, জেলা পুলিশ সুপার হারুনুর রশিদ, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলম, এডিএম রাহেনুল ইসলাম, সিভিল সার্জন সৈয়দ মঞ্জুরুল হক উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে সিলেট কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ছগির মিয়া জানিয়েছেন, দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকরের পর চিকিৎসকরা তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন ঘটে যে কজন ব্যক্তির হাত ধরে, তাদের অন্যতম হলেন মুফতি আবদুল হান্নান। হান্নান পাকিস্তানে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বাংলাদেশে নিজে বিভিন্ন জঙ্গি হামলার প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই শেখ হাসিনাকে দুবারসহ মোট চারবার হত্যার চেষ্টা করেন এই মুফতি হান্নান। সাত বছরে ১৭টি নাশকতার হামলায় সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। এসব হামলায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারের মসজিদ প্রাঙ্গণে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা ও তিনজন নিহত হওয়ার মামলার বিচারের রায় কার্যকর করা হলো মুফতি আবদুল হান্নানসহ তিন জঙ্গিকে ফাঁসি দিয়ে। অবসান ঘটল ভয়ঙ্কর জঙ্গি মুফতি আবদুল হান্নান যুগের।

ফাঁসির রায় কার্যকর করার মুহূর্তের খবর জানতে সাধারণ মানুষ সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখেন। জঙ্গি নেতার ফাঁসি হচ্ছে এমন খবরে মানুষের মনে যেমন আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল, তেমনি ছিল আতঙ্ক, যে কারণে সন্ধ্যার পর থেকেই রাজধানীসহ দেশের বড় শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে যান চলাচল কমে যায়। সন্ধ্যার পর থেকে কারাগারের আশপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় দোকানপাট। কারাগারের বাইরে র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা নিরাপত্তাব্যূহ তৈরি করেন।

সকাল থেকে কাশিমপুর কারাগারের ফাঁসির মঞ্চ ঘিরে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়। বিকালেই ফাঁসি কার্যকরের স্থান পরিদর্শন করে কারা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো কারাগারে আনার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও দেখা হয়। সোমবার মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় কার্যকরের নির্বাহী আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারাগারে পৌঁছায়।

মুফতি হান্নানের পরিবারের সদস্যরা সকালে কামিশপুর কারাগার ঘুরে যাওয়ার পর বিকালের দিকে বদলে যেতে থাকে কারাগারের সামনের দৃশ্যপট। বিকাল ৪টার দিকে ডিআইজি প্রিজন মো. তৌহিদুল ইসলাম কারাগারে প্রবেশের পরপরই কমিউনিটি পুলিশের প্রায় ৩০ জনের একটি দল কারাফটকের ভিতরে যায়। সাড়ে ৪টার দিকে কারাগারে যাওয়ার সড়কের দুই পাশের সব দোকানপাট বন্ধ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া আশপাশের মানুষকে কারাগারের সামনের সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিকাল ৫টার দিকে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দলকে কারাফটকের সামনে অবস্থান নিতে দেখা যায়। একটু পর দেখা যায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যদের। কারাগারের সামনের সড়কে টহল দিতে দেখা যায় র‌্যাবের একটি গাড়ি। সোয়া ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি কারাগারে প্রবেশ করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঢোকে দুটি অ্যাম্বুলেন্স। কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন ও অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ইকবাল হাসানকেও রাত ৮টার দিকে কাশিমপুর কারাগারে প্রবেশ করতে দেখা যায়।

একজন কারা কর্মকর্তা জানান, ফাঁসি কার্যকর করার জন্য প্রধান জল্লাদ হিসেবে রাজু এবং তার সহযোগী হিসেবে শরিফুল ইসলাম ও ইকবাল হোসেনকে বিকালেই বাছাই করা হয়। কাশিমপুর কারা কমপ্লেক্সের ইমাম মাওলানা মো. হেলাল উদ্দিনকে কয়েদিদের তওবা পড়ানোর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। তবে তওবার কাজটি করানো হয় একজন কারা কর্মচারী দিয়ে।

দুপুরের দিকে কারা চিকিৎসক মো. মিজানুর রহমান ফাঁসির দুই কয়েদি মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল বিপুলের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান। সন্ধ্যার পর আরেক দফা তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়।

এদিকে গতকাল রাত ১০টা ১ মিনিটে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেটের সিনিয়র জেল সুপার মো. ছগির মিয়া। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু সাফাত মো. শাহেদুল ইসলাম, ডিআইজি প্রিজন এ কে এম ফজলুল হক, কারা মসজিদের ইমামসহ প্রশাসন ও কারাগার-সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। রায় কার্যকর করার পর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রিপনের গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের কোনাগাঁও গ্রামের উদ্দেশে রওনা হন।

এর আগে গতকাল সন্ধ্যায় রিপনের সঙ্গে তার স্বজনরা শেষবারের মতো দেখা করেন। সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে রিপনের বাবা আবু ইউসুফ এবং মাসহ পরিবারের ২৫ সদস্য কারাগারে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর মধ্যে কয়েকজন নারী ও শিশু ছিল। দুটি মাইক্রোবাস ও একটি সিএনজি অটোরিকশাযোগে তারা কারাগারে প্রবেশ করেন। ফাঁসির রায় কার্যকরে জল্লাদ ফারুকের নেতৃত্বে তার আরও ৯ সহযোগী অংশ নেন।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জঙ্গি রিপনের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের কাগজপত্র আসে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে। এরপর কারা কর্তৃপক্ষ আবেদন নাকচের চিঠিটি পড়ে শোনায়। বিকালে রিপনের সঙ্গে দেখা করেন তার মা-বাবাসহ পরিবারের ছয় সদস্য। দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসির রায় কার্যকর ঘিরে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় ছিল কঠোর নিরাপত্তা।

২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারের মসজিদ প্রাঙ্গণে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। হামলায় পুলিশের এএসআই কামাল উদ্দিন, কনস্টেবল রুবেল আহমদ ও হাবিল মিয়া নামের এক ব্যক্তি নিহত এবং আনোয়ার চৌধুরীসহ ৭০ জন আহত হন। এ ঘটনায় করা মামলায় ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর মুফতি হান্নান, শরীফ শাহেদুল ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার ওরফে রিপনকে মৃত্যুদণ্ড এবং মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ও আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেয় সিলেটের দ্রুত বিচার আদালত। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা। তবে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি আপিল করেনি। গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টের রায়েও মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে তিন জঙ্গির। পরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হুজি নেতা মুফতি হান্নান, বিপুল ও রিপন আপিল করে। ৭ ডিসেম্বর তাদের আপিল আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন রিভিউ আবেদন করলে শুনানি শেষে ১৯ মার্চ সে আবেদনও খারিজ হয়। ২১ মার্চ রিভিউ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ২২ মার্চ হুজি নেতা মুফতি হান্নান, শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল এবং দেলোয়ার ওরফে রিপনের রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে এসে পৌঁছায়। সিলেট কারাগারে থাকা দেলোয়ার ওরফে রিপনকে এ রায় পড়ে শোনানো হয়। পরে ওই দিন সন্ধ্যায় এ তিন জঙ্গির মৃত্যু পরোয়ানা বিচারিক আদালত থেকে কারাগারে পৌঁছায়। ২৭ মার্চ রিপন রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিতভাবে প্রাণভিক্ষার আবেদন করে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে প্রাণভিক্ষার আবেদনও নাকচ হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর