সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

এখনো আতঙ্ক মামলা নিয়ে

আদালতের দ্বারে দ্বারে বিএনপির সিনিয়র নেতারা, ২৬ হাজার মামলায় ৫ লাখ আসামি

মাহমুদ আজহার

বিএনপি চেয়ারপারসন গুলশান কার্যালয়ে যতক্ষণ থাকেন বেশির ভাগ সময়ই তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে মামলা নিয়ে কথা বলেন। তার বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা চলছে। সব মামলারই চার্জশিট হয়েছে। কোন মামলার কী অবস্থা, নতুন করে কবে হাজিরা দিতে হবে— এসব নিয়েই এখন ব্যস্ত সময় পার করেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তাকে যেতে হয় আদালতে। এই দুই মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। দুর্নীতির এক মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও দলের     সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে এরই মধ্যে সাত বছর সাজাও দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আরও অন্তত ৩৬টি মামলার খড়গ ঝুলছে। দুর্নীতির আরেক মামলায় তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। কার্যত, মামলার যাঁতাকলে জিয়া পরিবারের সদস্যরা। শুধু জিয়া পরিবারই নয়, ৮৬ মামলার আসামি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম; প্রায় প্রতিদিনই আদালতের দোরে দোরে ঘুরতে হয় তাকে। তার বিরুদ্ধে ৩৯টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। দলের সিনিয়র নেতাদের প্রায় সবারই এ অবস্থা। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অবস্থা আরও করুণ। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। দলীয় প্রধানের সাজা হলে বিএনপির ঐক্য ধরে রাখা কঠিন হবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতেই একের পর এক মামলা দেওয়া হচ্ছে শীর্ষ নেতা থেকে তৃণমূলের কর্মী পর্যন্ত সবার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিকভাবে বিএনপির সঙ্গে পেরে উঠছে না বলেই ওরা এমন পথ বেছে নিয়েছে। গ্রামের মোড়লরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেভাবে মিথ্যা মামলা দেয়, বিএনপির বিরুদ্ধে সরকার তা-ই করছে। তারা চেষ্টা করছে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব যেন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে। কোনো রাজনৈতিক দল দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পরই এ ধরনের কাজ করে।’ দলীয় কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২৬৭৩৩ মামলা হয়েছে। এগুলোয় আসামির সংখ্যা পাঁচ লাখেরও ওপরে। এ ছাড়া রাজনৈতিকভাবে গুম, খুন ও অপহরণ করা হয়েছে ৪৩৬ জনকে। এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ গুম করা হয়েছে ২৭ জনকে। এর মধ্যে ১২ জনই ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের নেতা। সারা দেশে ১০ হাজারের ওপর নেতা-কর্মী কারাগারে রয়েছেন। সর্বশেষ জেলে যান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। মামলা হওয়া নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ৬টি মামলার সবগুলোতেই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলার মধ্যে ৯টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। তরিকুল ইসলামের ৮টি মামলার ৫টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এম কে আনোয়ারের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলার মধ্যে ১৮টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ২৬টি মামলার মধ্যে ১৪টিতেই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৪৩টি মামলার মধ্যে ২৮টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। গয়েশ্বর রায়ের বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলার মধ্যে ১৮টিতেই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৯টি মামলার মধ্যে ৩টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে। সর্বমোট ১৩৬টি। মামলার তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তার বিরুদ্ধেও ১২৮টি মামলা। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মামলা তদারক করেন পুলিশের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাহউদ্দিন খান বিপিএম। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘জেলা পর্যায় ও নেতাদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য, মামলার এজাহার দেখার পাশাপাশি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেই এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। নিত্য নতুন অনেক মামলাই হচ্ছে। সেগুলোর তথ্য পেলেই আমরা তালিকায় যুক্ত করব।’

খালেদা-তারেকের কী হবে : দুর্নীতির এক মামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাজা হয়ে যাওয়ায় আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়াও অনিশ্চিত। বিএনপি চেয়ারপারসন দণ্ডিত হলে দল কীভাবে চলবে তা নিয়েও নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রশ্নের শেষ নেই। এরই মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই রায় আসতে পারে। এ দুই মামলায় খালেদা জিয়া প্রধান আসামি। একটিতে রয়েছেন তার বড় ছেলে তারেক রহমানও। বিএনপি প্রধানের বিরুদ্ধে গ্যাটকো ও নাইকো দুর্নীতি মামলাও চলছে। এরই মধ্যে নাইকো দুর্নীতি মামলায় তাকে দুই মাসের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চাঞ্চল্যকর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাও চলছে দ্রুতগতিতে। ওই মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রে তারেক রহমানের নাম রয়েছে। ওই মামলার বিচারকাজও চলছে দ্রুতগতিতে। অবশ্য মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেছেন।

বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, ন্যায়বিচার পেলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া কোনো মামলা উচ্চ আদালতে টিকবে না। তারা বলছেন, সব মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। খালেদা জিয়ার মামলার আইনজীবী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পাব কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছি। কারণ বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। বিএনপি এক বটবৃক্ষ। একে ভাঙার শক্তি সরকারের নেই। জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চেয়ারপারসনকে সাজা দিলেও দল ভাঙতে পারবে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর