মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রকল্প শেষ কবে কেউ জানে না

১৫৬টি ফায়ার স্টেশন নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি ২৪ ভাগ, প্রকল্পের ব্যয় ৮৮৮ থেকে বেড়ে ১২৫৭ কোটি টাকা ২০০৬ থেকে তিন ধাপে প্রকল্পের কাজ শুরু, হয় শুধু চলাচলের গাড়ি কেনা, মূল কাজের খবর নেই

নিজামুল হক বিপুল ও সাখাওয়াত কাওসার

প্রকল্প শেষ কবে কেউ জানে না

সারা দেশে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের তিনটি প্রকল্পের কাজ কবে শেষ হবে কেউ জানে না। অথচ এটি সরকারের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। ২০১২ সালে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের সবচেয়ে বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর আগে ২০০৬ সালে নেওয়া হয় ৭৮টি স্টেশন নির্মাণের প্রকল্প। আর ২০১১ সালে নেওয়া হয় ২৫টি স্টেশন নির্মাণ প্রকল্প। দীর্ঘ ১০ বছরেও এই তিন প্রকল্পের একটির কাজও পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ হয়নি। তবে প্রকল্পের কাজে অগ্রগতি না হলেও গাড়ি কেনায় পিছিয়ে নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ২০০৬ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি গতকাল পর্যন্ত মাত্র ৩৫ শতাংশ। ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণকাজের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটির কাজের অগ্রগতি মাত্র ২৪ শতাংশ। অথচ তিন ভাগে বাস্তবায়নকৃত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের দুটি ভাগে ইতিমধ্যে ডিপিপি সংশোধন করে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্পটিকে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের দাবি, তিনটি প্রধান কারণে  ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প  বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী নির্মাণ কাজের খরচ বেড়েছে। একই সঙ্গে আগের চেয়ে এখন ভবনের আয়তনও বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং জমির মূল্য বেড়েছে আগের তুলনায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেবা সুরক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা এবং ফায়ার সার্ভিস নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী সারা দেশে প্রতিটি উপজেলা সদরে একটি করে আধুনিক ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণে পৃথক তিনটি প্রকল্প নেওয়া হয় ২০০৬, ২০১১ ও ২০১২ সালে। এর মধ্যে ২০১১ ও ২০১২ সালে বর্তমান সরকারের গত মেয়াদে নেওয়া হয় দুটি প্রকল্প। একটি ডিপিপিতে ২৫টি এবং অন্য ডিপিপিতে ১৫৬টি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের জন্য কাজ শুরু করে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১২ সালে ১৫৬টি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার; যার নির্মাণ শেষ করার মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। এই প্রকল্পের জন্য সরকারের বরাদ্দ ছিল ৮৮৮ কোটি টাকা। কিন্তু নির্ধারিত এই সময়ের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আর কোনো সুযোগ নেই। এ অবস্থায় প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার এই প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়েছেন সংশোধিত বাজেটের মাধ্যমে। গত ৩ জানুয়ারি সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন পায়; যাতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। একই সঙ্গে এর ব্যয় ৮৮৮ কোটি থেকে বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১২৫৭ কোটি টাকায়। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা তো দূরের কথা, ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজই শুরু হয় ২০১৩ সালের শুরুর দিকে। এই সময় থেকে গতকাল পর্যন্ত ১৫৬টি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণ প্রকল্পের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২৮টির। এর মধ্যে চালু হয়েছে ৪টি। আরও ১২টির নির্মাণ জুনের মধ্যেই শেষ হবে বলে জানিয়েছেন বৃহৎ এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. আতাউল হক। শতাংশের হিসাবে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২৪ শতাংশ। পিডির দাবি, জমি কেনার জন্য যে টাকা সরকার বরাদ্দ করেছিল সেই টাকায় জমি কেনা বেশ কঠিন হওয়ার কারণেই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি জানান, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণের জন্য জমি কেনা বাবদ সরকার ১১ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকার একটা সিলিং নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু এই টাকা দিয়ে দেড় বছর ধরে জমি কেনা যাচ্ছে না। কারণ সরকার মৌজাভেদে জমির দাম নির্ধারণ করে দেওয়ায় এই টাকায় কারও কাছ থেকে জমি কেনা যায়নি। প্রকল্পটি ২০১২ সালে অনুমোদন পাওয়া। অথচ সরকার জমির দাম মৌজাভেদে নির্ধারণ করেছে এক বছর আগে। তাহলে কেন জমির দাম নির্ধারণের আগে সরকারের দেওয়া মূল্যে জমি কেনা হলো না— জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, সরকার জমি কেনার জন্য যে সিলিং নির্ধারণ করে দিয়েছিল সেই টাকা দিয়ে ৩০ থেকে ৩৫টি ফায়ার স্টেশন নির্মাণের জমি কেনা গেছে। বাকিগুলো কেনা যায়নি। পিডি জানান, তার প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে গতকাল পর্যন্ত ১০২টি ফায়ার স্টেশন নির্মাণের জন্য জমি কেনার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৩৫ জন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে জমি কেনার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পিডি আরও দাবি করেন, এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ার আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে আগের ডিপিপিতে ১৮০০ বর্গফুট আয়তনের ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল। এখন সেটি হবে ২৫০০ বর্গফুট আয়তনের। আর ডিপিপি করা হয়েছিল ২০১২ সালের কনস্ট্রাকশনস রেইট শিডিউল অনুযায়ী। কিন্তু ২০১৪ সালের নতুন রেইট শিডিউল ইতিমধ্যে চলে এসেছে। এ কারণে ব্যয় বেড়েছে। ১৫৬টি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণ প্রকল্প ছাড়াও পৃথক আরেকটি প্রকল্পে ৭৮টি স্টেশন নির্মাণের জন্য ডিপিপি অনুমোদন দেওয়া হয় ২০০৬ সালে। ব্যয় ধরা হয় ১৫২ কোটি টাকা। ২০০৬ সালে নেওয়া এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের ডিসেম্বরে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়নি। বরং ২০১৪ সালে এসে ডিপিপি সংশোধন করা হয়। তখন আরও ৪টি স্টেশন নির্মাণের বিষয় যুক্ত করা হয়। এর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৭৭ কোটি টাকায়। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের জুনে। কিন্তু প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে তারা কাজ শেষ করার আশা করছেন।

প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আবদুর রাজ্জাক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইতিমধ্যে ৮২টির মধ্যে ৬০টির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ৪টি আটকে আছে জমি নিয়ে মামলার কারণে। জমি কেনা না যাওয়ায় ৪-৫টির স্থান নির্ধারণ করা যায়নি। আর টাকার অভাবে ৭টির কাজ করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এই সমস্যা হচ্ছে। ২০১১ সালে নেওয়া আরেক প্রকল্পে ছিল ২৫টি স্টেশন নির্মাণের কাজ। ১৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের নির্মাণ শেষ করার কথা ছিল চলতি বছরের জুনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। এখন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক আবু নূর মোহাম্মদ বজলুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তার প্রকল্পের ২৫টির মধ্যে ৫টি স্টেশন চালু হয়েছে। আর ১২টির নির্মাণকাজ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। সময় বাড়ার কারণে এখন ডিপিপি সংশোধন করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এতে ব্যয়ও কিছুটা বাড়বে। এই তিন প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান বলেন, ফায়ার স্টেশন বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। ফায়ার স্টেশন বাড়ানোর জন্য সরকার প্রকল্প করে দিয়েছে। এরই মধ্যে ৪৭টি স্টেশন কাজ শুরু করে দিয়েছে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, আগের জনবল দিয়েই এই ফায়ার স্টেশনগুলোর কাজ চালানো হচ্ছে। আগামী জুনের মধ্যে আরও ৫২টি ফায়ার স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ হবে। ওই স্টেশনগুলোর কার্যক্রমও বর্তমান জনবল দিয়ে করাতে হবে।

সর্বশেষ খবর