বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভোটের সময় চার্জশিটের তথ্য গোপন করেছিলেন সাক্কু

১ কোটি ১২ লাখ টাকার অবৈধ আয়ের মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভোটের সময় চার্জশিটের তথ্য গোপন করেছিলেন সাক্কু

ভোটের সময় মামলার অভিযোগপত্রের তথ্য গোপন রেখেই দ্বিতীয়বারের মতো কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন মনিরুল হক সাক্কু। তার বিরুদ্ধে গতকাল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. কামরুল হোসেন মোল্লা। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের মামলায় তার বিরুদ্ধে এ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। একই সঙ্গে আদালত তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোকেরও আদেশ দিয়েছে। ১ কোটি ১২ লাখ টাকারও বেশি সম্পদের তথ্য গোপন করার অপরাধে রাজধানীর রমনা থানায় দায়ের করা একটি মামলায় মনিরুল হক সাক্কুর বিরুদ্ধে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত এই মেয়রের নির্বাচনে জয়ী হওয়া সংক্রান্ত গেজেট গতকাল প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। গত ৩০ মার্চ ভোট হওয়ার দুই সপ্তাহ পর মনিরুল হক সাক্কুর নাম ঠিকানাসহ গেজেটে প্রকাশ হলো। এখন তার শপথ নেওয়ার বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দেখবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। মামলার বিবরণী ও অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, মনিরুল হক সাক্কু এবং তার স্ত্রী আফরোজা জেসমিনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৭ জানুয়ারি রাজধানীর রমনা থানায় দুদক আইন ২০০৪ ২৬(২), ২৭(১) ধারা, দণ্ডবিধির ১০৯ ধারা তৎসহ জরুরি ক্ষমতা বিধিমালা ২০০৭-এর বিধি ১৫ঘ(৫) আওতায় একটি মামলা দায়ের করেন দুদক সমন্বিত কুমিল্লা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শাহীন আরা মমতাজ। মামলার বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়, দুদক কুমিল্লা কার্যালয়ের অনুসন্ধান নং-৬/২০০৭ সংযোগে সংগৃহীত তথ্যের আলোকে কুমিল্লা পৌরসভার (তৎকালীন) মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর নামে দুদকের ইস্যুকৃত সম্পদ বিবরণী নোটিসের বিপরীতে তিনি নির্ধারিত ছকে তার সম্পদের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। ওই এজাহারে উল্লেখ করা হয়, তিনি ১ কোটি ২৮ লাখ ১১ হাজার ৭৪৩ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। মামলার এজাহারে বলা হয, সাক্কু ঢাকায় চারটি প্লটের বিপরীতে ৮ লাখ ৩৫ হাজার ৬০৪ টাকার তথ্য গোপন করেছেন। কুমিল্লার রেস কোর্সের ২৩ দশমিক ০০৪ শতক জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ৩৭ লাখ টাকার তথ্য গোপন করেছেন। একইভাবে রাজধানীর লালমাটিয়ায় একটি ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করেছেন ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়া রাজধানীর একটি ব্যাংকে এফডিআর এর হিসাব গোপন করেছেন। যেখানে ১৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা রয়েছে। একইভাবে কুমিল্লার একটি ব্যাংকে দুটি এফডিআর অ্যাকাউন্টের তথ্যও গোপন করেছেন তিনি। ওই দুই অ্যাকাউন্টে মোট ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৮৮ টাকা রয়েছে।

এজাহারে আরও বলা হয়, বালুমহালের আয় (রয়্যালিটি ছাড়া) বাবদ ৬৬ লাখ ৪০ হাজার টাকার কথা উল্লেখ করলেও সাক্কু এখানে তথ্য গোপন করেছেন ৫৩ লাখ ৩৮ হাজার ৬৩৬ টাকার। সব মিলিয়ে তার স্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন করা হয় মোট ১ কোটি ২৮ লাখ ১১ হাজার ৭৪৩ টাকার।  জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বিষয়ে দায়ের করা এই মামলার তদন্ত শেষে দুদকের সহকারী পরিচালক নুরুল হুদা গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেয় দুদক। অভিযোগপত্রে বলা হয়, জব্দকৃত রেকর্ডপত্র, প্রাপ্ত তথ্য, সাক্ষ্য প্রমাণাদি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে মনিরুল হক সাক্কু দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে নিজের এবং স্ত্রীর ঘোষিত আয়ের বাইরে ৪ কোটি ৫৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৩৩ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন এবং ১ কোটি ১২ লাখ ৪০ হাজার ১২০ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। ওই সময় তাকে পলাতক দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির জন্য অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। অভিযোগপত্র দাখিলের সময় দুদক মামলা থেকে সাক্কুর স্ত্রী আফরোজা জেসমিনকে অব্যাহতি দেয়। প্রায় এক বছর আগে এই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল হলেও গত ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে মনিরুল হক সাক্কু নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় রমনা থানায় দুদকের দায়ের করা এই মামলার অভিযোগপত্রের বিষয়টি গোপন রাখেন। গত ২ মার্চ নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তার হলফনামা থেকে দেখা যায়, সাক্কু সেখানে মামলার বর্তমান অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন এই মর্মে যে, রমনা থানার মামলা নম্বর-১১, মামলাটি চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা আমলে নিয়েছেন এবং এটি আমলে গ্রহণ সম্পর্কিত শুনানির অপেক্ষায় আছে। হলফনামা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, নিজের বিরুদ্ধে থাকা সম্পদের তথ্য গোপন মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিলের কথা গোপন রেখেই কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচনে অংশ নেন বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু। তিনি নির্বাচিতও হন। অবশ্য মেয়র মনিরুল হক সাক্কু গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের কুমিল্লা প্রতিনিধির কাছে দাবি করেছেন, ‘এ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট থেকে আমি স্থায়ী জামিন নিয়েছি। আদালতে হাজির না হওয়ার কারণে এ আদেশ জারি করা হয়েছে। বুধবার আদালতে এ সম্পর্কিত কাগজপত্র তুলে ধরব।’

কুমিল্লায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া : আমাদের কুমিল্লা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কুর বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির খবরে কুমিল্লায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও ভাইরাল হয়ে যায়।

স্থানীয় বিএনপির নেতারা এ মামলা থেকে তাকে অব্যাহতির আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া বলেছেন, সাক্কু জনপ্রিয় ও নির্বাচিত মেয়র। তার বিরুদ্ধে এ মামলাটি দুদক বাদী হয়ে বিতর্কিত ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের ১/১১ সরকারের সময়ে দায়ের করেছিল। তিনি দাবি করেন, মামলাটি হয়রানিমূলক। সরকারের উচিত তাকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া। কুসিকের সাবেক প্যানেল মেয়র ও গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আঞ্জুম সুলতানা সীমা বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। তদন্ত ও বিচারে মনিরুল হক সাক্কু দোষী হলে তার বিচার হওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সহসভাপতি ও কুমিল্লা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক আলহাজ মো. ওমর ফারুক বলেছেন, সাক্কুর হলফনামায় দুর্নীতির এ মামলার তথ্য রয়েছে। সে দুর্নীতি না করলে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় পালিয়ে থাকার কথা নয়। তিনি আরও বলেন, গত পাঁচ বছরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে উন্নয়নের নামে যে দুর্নীতি হয়েছে এরই মধ্যে দুদক অনেক ফাইলপত্র নিয়েছে বলে শুনেছি। তদন্তের মাধ্যমে সব দুর্নীতির তথ্য উদঘাটনসহ বিচার হওয়া উচিত। বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক বদরুল হুদা জেনু বলেন, সাক্কুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকতেই পারে, গ্রেফতারও হতে পারেন। এ নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি আলী আকবর মাসুম জানান, সাক্কু কুমিল্লা সিটির সদ্য নির্বাচিত মেয়র। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে হঠাৎ করে এ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে।

সর্বশেষ খবর