বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

লুই কানের নকশা নিয়ে সিদ্ধান্তের অপেক্ষা

আহমদ সেলিম রেজা

নতুন নগর ও সংসদ ভবন এলাকা নিয়ে করা বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের পাঁচ সেট নকশা দেশে এসেছে গত ডিসেম্বরেই। এর মধ্যে রয়েছে ৮৫৩টি নকশার এক সেট সফট কপি এবং চার সেট কাগজের ৩ হাজার ৪১২টি নকশা। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাফেজখানা থেকে মোট ৪১টি বাক্সে ১ ডিসেম্বর এসব নকশা ঢাকায় পৌঁছে। এরপর স্থাপত্য অধিদফতরের স্থপতি সাইকা বিনতে আলমের নেতৃত্বে বাক্স খুলে নকশা বিন্যাসের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশের হাতে থাকা নকশার কপির সঙ্গে সার্টিফায়েড মূল নকশার সফট কপি ও হার্ড কপিগুলো মিলিয়ে চূড়ান্ত করা হয় লুই আই কানের ৮৫৩টি নকশার সেট। এখন শুধু অপেক্ষা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের। তার সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ী পরে শুরু হবে নকশা বাস্তবায়নের কাজ। এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার ও সিপিএ’র নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই লুই আই কানের ঐতিহাসিক এই নকশার পাঁচটি সেট বাংলাদেশে আনা সম্ভব হয়েছে। এখন আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে নকশা তুলে দেওয়ার অপেক্ষা করছি। খুব শিগগিরই তিনি এ বিষয়ে আমাদের সময় দেবেন। আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী সময় দিলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে আগামী মে মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে লুই কানের নকশা উন্মোচন করা সম্ভব হবে। এরপর এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীই সিদ্ধান্ত দেবেন— নকশাগুলো কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে যাবে, কী করা হবে, কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে স্পিকার বলেন, ‘নকশা বাস্তবায়নের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এটা সংসদের আওতায় পড়ে না। আমি জানি জাতীয় সংসদে সংরক্ষণের জন্য এই নকশার এক সেট আমাদের দেওয়া হবে। এ ছাড়া স্থাপত্য অধিদফতর, জাতীয় আর্কাইভ, জাতীয় জাদুঘরের কাছে এক সেট করে নকশা দেওয়া হতে পারে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীই দেবেন। এরপর তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যেখানে যেটা রাখার, সেখানে সেটা পাঠানো হবে।’ প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে এসব নকশা হস্তান্তর করবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সংসদ সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব আ ই ম গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ লুই আই কানের নকশার সার্টিফায়েড কপি আনার সিদ্ধান্ত নেয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর নির্দেশে সংসদ সচিবালয়ের পক্ষে নকশা গ্রহণকারী প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলাম আমি। আমাদের কাজ ছিল চুক্তি অনুযায়ী নকশাগুলো বুঝে নেওয়া। সে অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাফেজখানা থেকে আমরা লুই কানের তৈরি ৮৫৩টি নকশার ৩ হাজার ৪১২টি হার্ড কপি ও এক সেট সফট কপি বুঝে নিই। গত বছর ১ ডিসেম্বর নকশা নিয়ে আমরা ঢাকায় পৌঁছি। ৮ ডিসেম্বর স্পিকারের উপস্থিতিতে সংসদ ভবনের ২ নম্বর স্থায়ী কমিটির কক্ষে নকশার বাক্স খোলা হয়। স্থাপত্য অধিদফতরের স্থপতি সাইকা বিনতে আলমের নেতৃত্বে কর্মকর্তারা এরপর নকশা বিন্যাসের কাজ করেন।’ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নকশা হাতে পাওয়ার পরই লুই আই কানের নকশা অনুযায়ী নতুন ঢাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে হাত দেবে সরকার। নতুন সচিবালয়সহ অনেক নতুন স্থাপনা গড়ে তোলা হবে। এ ছাড়া উচ্ছেদ হবে নকশাবহির্ভূত অনেক স্থাপনা। জানা যায়, সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের মূল নকশা আমলে না নিয়ে ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের শাসনামলে চন্দ্রিমা উদ্যানে ৫ বিঘা জমির ওপর সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধি কমপ্লেক্স, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। এর আগে ১৯৮১ সালের ২ জুন সংসদ ভবনের উত্তরে ক্রিসেন্ট লেকের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এখানে পুনর্দাফন করা হয় চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। এরপর এর নামকরণ করা হয় জিয়া উদ্যান। এই উদ্যানে যাতায়াতের জন্য ক্রিসেন্ট লেকের ওপর তৈরি করা হয় ঝুলন্ত সেতু। এ ছাড়া সংসদ ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় দাফন করা হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও আতাউর রহমান খান, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুরকে। এখানে আরও রয়েছে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার তমিজউদ্দীন খানের কবর। নকশার বিষয়টি আমলে না নিয়ে চন্দ্রিমা উদ্যানের পাশে ১০ একর খালি জমিতে জোট সরকারের আমলে তৈরি করা হয় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। পাশাপাশি নকশাবহির্ভূতভাবে সংসদ ভবন এলাকায় নির্মিত হয় স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের জন্য আবাসিক ভবন। এ বিষয়ে আদালতের একটি নির্দেশনাও রয়েছে। লুই কানের মূল নকশা বাস্তবায়ন শুরু হলে নকশাবহির্ভূত এসব স্থাপনা উচ্ছেদের মুখে পড়বে। জাতীয় সংসদেও নকশাবহির্ভূত সব স্থাপনা অপসারণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়। গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন এ বিষয়ে সংসদে বলেছেন, কারও কবর সরানোর জন্য কিছু করা হবে না। লুই আই কানের নকশা যেভাবে আছে, সে অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যা যা করণীয় সবই করবে সরকার। জানা যায়, ২০১৫ সালে পরিকল্পনা কমিশনের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লুই কানের নকশার ভিত্তিতে শেরেবাংলানগরে বাংলাদেশ সচিবালয়ের নতুন কমপ্লেক্স নির্মাণের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী প্রকল্প তৈরির সময় লুই আই কানের নকশা খুঁজে আনার বিষয়টি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়। এর আগেই সংসদ এলাকায় নকশাবহির্ভূত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন নির্মাণ বন্ধ করতে পরিবেশবাদীরা আদালতে গেলে এক রায়ে লুই আই কানের নকশা আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে নকশা আনার উদ্যোগ নেয় সরকার।

সর্বশেষ খবর