বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভারতে চুক্তি-সমঝোতা জনসম্মুখে তুলে ধরুন

নূরে আলম সিদ্দিকী

ভারতে চুক্তি-সমঝোতা জনসম্মুখে তুলে ধরুন

সম্প্রতি বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে তার হৃদয়ের যে অভিব্যক্তিটি তুলে ধরেছেন, তাতে সন্দেহাতীতভাবে আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-প্রত্যাশার মাঝে একটু হলেও হতাশা ও হৃদয়ের অনুভূতির বেদনাবিধ্বস্ত দীর্ঘশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। শেখ হাসিনা সাগরের ঊর্মিমালার মতো উচ্ছ্বসিত হৃদয় এবং দিগন্তবিস্তৃত আকাশের মতো উদার চিত্ত নিয়ে ভারত সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে, তিনি মাদার তেরেসার মতো মিশনারি নন। বরং তেরেসা মে’র মতো একটি রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান। প্রান্তিক জনতার চাওয়া-পাওয়া, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের প্রাপ্তি-প্রত্যাশাকে প্রতিটি মুহূর্তেই তাকে গুরুত্ব সহকারে অতি সযত্নে বক্ষে লালন করতে হয়।

এই সফরে যে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে ছিলেন, এটি ভারতীয় কোনো প্রণোদনা নয়। বরং প্রণব মুখার্জি আমাদের স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তার যে, আবেগাপ্লুত শ্রদ্ধাবিগলিত অনুভূতি ও উচ্ছ্বাস হৃদয়ের গভীরে লালন করেন এবং সেই সুবাদে শেখ হাসিনার প্রতি তার কন্যাপ্রতিম স্নেহানুভূতি বিদ্যমান। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, প্রটোকল ভেঙে প্লেনের সিঁড়ির কাছে এসে স্বাগত জানানোর ঘটনাটি শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের প্রতি নরেন্দ্র মোদির একটি বিরল সম্মান প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত। নরেন্দ্র মোদি কূটনৈতিক কৌশলে কুশলী এটা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। সমগ্র বিশ্বে তার পরিচিতিও তাই। তার দলীয় আঙ্গিকে এবং তার স্বীয় মননশীলতার আবর্তে কিছু অর্জন করার জন্য তিনি যে বদ্ধপরিকর— এটা বিশ্ব কূটনৈতিক মহল নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছেন। শেখ হাসিনার এই সফরে মোট ছয়টি চুক্তি ও ২২টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। যদিও তিস্তা এবারের সফরের মূল আলোচনার সূচিতেই ছিল না। তবুও শেখ হাসিনার মনন জুড়ে একটি আকাঙ্ক্ষা ও আশার আলো প্রজ্বলিত ছিল যে, তিনি তিস্তা সমস্যার একটা ন্যায্য ও সম্মানজনক সমাধান করে দেশ ও জাতিকে আশ্চর্যান্বিত করে দেবেন, তাক লাগিয়ে দেবেন। প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতা দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয় দহনে তার অনুভূতিকে নির্মমভাবে দগ্ধীভূত করেছে। সংবাদ সম্মেলনে সেটা তার ভাষা ও শারীরিক ভঙ্গিতে কিছুটা হলেও পরস্ফুিটিত হয়েছে। এটা বিস্মৃত হলে হয়তো ভুল হবে, তার ধমনীতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত নিত্য প্রবহমান। তবে মুজিব ভাইয়ের গিরিশৃঙ্গমালার মতো উদ্যত, উদ্গত ও উদ্ধত ব্যক্তিত্ব তার পুরোটা নেই— এটাই বাস্তবতা। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা সত্ত্বেও সংবাদ সম্মেলনে তার শব্দচয়ন এবং দেহের ভাষায় অসন্তোষের কিছুটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সন্দেহাতীতভাবে। এটি অনেকের মতো আমারও গোচরীভূত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি প্রণিধানযোগ্য তিনটি উক্তি করেছেন। ১. আনতে গেলাম পানি, নিয়ে এলাম বিদ্যুৎ। ২. আমরা আমাদের নদী ড্রেজিং করে বর্ষাকালীন পানি সংরক্ষণ করে শুকনো মৌসুমের অভাব পূরণের চেষ্টা করব। ৩. মমতা ব্যানার্জির বিকল্প প্রস্তাবে তোর্সা ও জলঢাকাসহ পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলীয় চারটি ছোট নদীর পানি প্রবাহের গতি পাল্টে বাংলাদেশকে প্রদানের বিকল্প প্রস্তাবেরও যথাযথ জবাব প্রদান করে তিনি বলেছেন, ওই পানি তিস্তায় নিয়ে এসে তিস্তা থেকেই আমাদের পানি প্রদান করুন। এটি শুধু তার মানসিক তিক্ততার প্রকাশ নয়, মমতার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এটি তার তিক্ত হৃদয়ের তাত্ক্ষণিক যৌক্তিক অভিব্যক্তি ও প্রতিক্রিয়া।

সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা আত্মসম্মান রক্ষার্থে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন যে, নরেন্দ্র মোদি আশ্বাস দিয়েছেন, তার ও শেখ হাসিনার শাসনামলেই তিস্তা চুক্তি হবে। আমার কাছে এটা ছেলেভুলানো ছড়ার মতোই। অবশ্য প্রণব মুখার্জির রাষ্ট্রপতির মেয়াদ যদি দীর্ঘায়িত হতো তাহলে তার অকৃত্রিম প্রচেষ্টা আন্তরিকভাবেই অব্যাহত রাখতেন; এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। এখানে আমি মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণ করে প্রত্যয়দৃঢ় চিত্তে বলতে চাই, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে যে ভারত আমাদের এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল, অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল, যে শ্রীমতী গান্ধীর স্টেটসম্যানশিপ সারা বিশ্বকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন, ৭০-এর নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রতি ইয়াহিয়া খানের অযৌক্তিক অবজ্ঞা ও নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য পাকিস্তানের প্রতি সমগ্র বিশ্বের একাট্টা বিদ্বেষ সৃষ্টিতে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন, এমনকি খোদ আমেরিকার জনগণকে উদ্বেলিত করে রক্ষণশীল নিক্সন প্রশাসনকে সেন্টো-সিয়েটো চুক্তি থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়া থেকে নিবৃত্ত রাখার যে গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, আজকে নরেন্দ্র মোদি, যোগী আদিত্যনাথ, মনোহর পারিকরদের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভার প্রশাসন ভারতকে সেই অবস্থান থেকে প্রায় সরিয়ে এনে হিন্দুত্ববাদের পীঠস্থানে প্রতিস্থাপিত করেছে। তাদের চিন্তাচেতনায় ভারতবর্ষ নামটির প্রতিও নেতিবাচক একটি অনুভূতি লালন করেন। চারদিনের সফরের উষ্ণ অভ্যর্থনার মাঝেও শেখ হাসিনা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছেন, যেটি তার অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে অবশ্যই আঘাত করেছে, যাতে বোধহয় তিনি ব্যথিচিত্ত।

তা সত্ত্বেও যে ছয়টি চুক্তি ও ২২টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে; এগুলো আভাষে-ইঙ্গিতে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়, এটা সংসদে বিশেষ অধিবেশন ডেকে; অন্যথায় তার যাত্রার প্রাক্কালে আমি একটি নিবন্ধে বলেছিলাম, উল্লেখযোগ্য বিরোধী দল, সুশীল সমাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবীদের একটা সম্মেলন ডেকে তাদের মতামত যাচাই করে যাওয়া উচিত ছিল। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনার অভিজ্ঞতালব্ধ শক্তি বাড়ত, ভারতের সঙ্গে চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্নে তিনি আরও প্রত্যয়দৃঢ় হতে পারতেন। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় তিনি গোটা জাতি এবং প্রান্তিক জনতার উদ্বেলিত চিত্তেরই প্রতিনিধিত্ব করতেন।

সামরিক চুক্তির প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষ নিঃসংশয়চিত্ত নয়। তিস্তার পানি তো পায়ইনি, আমদানি-রপ্তানির ঘাটতি কতটুকু পূরণ হলো, তাও আজকে জনসম্মুখে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। সংবাদ সম্মেলনে যতটুকু উঠে এসেছে, তা অপ্রতুল। এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে একটি বিশেষ অধিবেশন ডাকা প্রয়োজন। এবং সব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করতে পারলে আরও ভালো হয়। বঙ্গবন্ধুর চেতনার উত্তরাধিকার এবং বঙ্গবন্ধুর অতি বিশ্বস্ত রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে শেখ হাসিনার কাছে আমার প্রত্যয়দৃঢ় দাবি— চুক্তি, সমঝোতা কোনো কিছুতেই ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় নয়, বরং অবারিত চিত্তে সবটুকুর চুলচেরা বিশ্লেষণ জনসম্মুখে তুলে ধরুন। সেটি যেমন প্রান্তিক জনতার কাম্য, তেমনি শেখ হাসিনার জন্যও কল্যাণকর। 

বেগম খালেদা জিয়া সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে যে তির্যক মন্তব্য করেছেন, তা যতখানি না যুক্তিনির্ভর ও বাস্তব, তারচেয়ে বেশি নেতিবাচক ও প্রতিহিংসাপূর্ণ। তথ্যবিবর্জিত তার সংবাদ সম্মেলনটি জনগণের অনুভূতিকে বিপর্যস্ত করেছে। বেগম খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবেন না যে, আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শ্রেণির সংগঠক এবং শেখ হাসিনার অনুকম্পা অর্জনের কোনো প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত না থেকে তার যাবতীয় অযৌক্তিক কার্যকলাপের তির্যক সমালোচনা করে থাকি। তবে বেগম জিয়ার সঙ্গে আমার সমালোচনার তফাৎ হলো, তিনি যে কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব করে টেনেহিঁচড়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে নিজে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে চান। অন্যদিকে আমার সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে তার বিপরীত এই কারণে যে, ক্ষমতার প্রশ্নে আমার চিত্ত একেবারেই নির্মোহ। দেশে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত থাকুক, উল্লেখযোগ্য সব দলের সার্বিক ও সন্দেহবিমুক্ত অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হোক— এটি আমার একান্ত কাম্য। দুই নেত্রীর কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকা তৈরিতে এবং ৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমাদের— বিশেষ করে আমার ভূমিকার গুরুত্ব, বৈশিষ্ট্য এবং নির্বাচনকে সফল করার কৃতিত্ব।

যদিও শেখ হাসিনা রক্তের উত্তরাধিকারিত্বের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতাসীন, তবুও তার আগমন একটি রাজনৈতিক পরিবারের অঙ্গন থেকে। কিন্তু খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ একেবারেই ক্ষমতাশ্রয়ী। শুধু স্বামীর সুবাদেই নয়, সামরিক ছাউনির পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধ। গণতান্ত্রিক পারিপার্শ্বিকতা-বিবর্জিত একটি রাজনৈতিক পরিবেশই তার রাজনৈতিক পথপরিক্রমণে উৎসাহ জোগায়। ফলে রাজনীতিতে তিনি শাঁখের করাত; আসতেও কাটেন, যেতেও কাটেন।

আমার এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য ভারত এবং এদেশের দুই সৌভাগ্যবতী নেত্রীর সমালোচনা, পর্যালোচনা নয়। বরং আমাদের পরিপূর্ণ স্থলভাগ পরিবেষ্টিত করে রাখা বিশাল ভারতের কাছে আমাদের স্বাধীন সত্তাকে সমুন্নত রেখে আমাদের প্রাপ্তি ও প্রাপ্যকে যথাযথভাবে আদায় করা এবং নতজানু হয়ে কোনো ন্যায্য দাবি ছাড় না দেওয়া ও সর্বক্ষেত্রে বিশেষ করে সামরিক অঙ্গনকে ভারতের প্রভাববিমুক্ত রাখা আমার একান্তই কাম্য।

     লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।    

সর্বশেষ খবর