বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

জনদুর্ভোগের জন্য দায়ী কারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

জনদুর্ভোগের জন্য দায়ী কারা

রাজধানীতে টানা চার দিন ধরে জনগণকে জিম্মি করে গণপরিবহনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে ভেঙে পড়েছে গণপরিবহন ব্যবস্থা। চরম দুর্ভোগে ঢাকার সাধারণ মানুষ। সংকট উত্তরণে গতকাল পর্যন্ত নেওয়া হয়নি বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ। এ ভোগান্তির দায় কার—এমন প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে। অভিযোগের তীর মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দিকে। সরকারও অনেকটাই নির্বিকার। এদিকে গতকালও রাজধানীতে ছিল চরম পরিবহন সংকট। ভোগান্তিতে ছিল সর্বস্তরের মানুষ। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন কর্মজীবী নারীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে পরিবহন ব্যবস্থায় কৃত্রিম সংকটের দায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পরিবহন মালিক সমিতির। আগে পরে কী ধরনের পরিণতি হতে পারে, তা না ভেবেই হুটহাট করে রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস পরিবহন বন্ধ করা ঠিক হয়নি। ঢাকাসহ সারা দেশের মালিক সমিতির নেতৃত্বে রয়েছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান ও ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের নেতা খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। দেশের পরিবহন শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের কার্যকরি সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ‘কেউ নানা অজুহাতে যদি গাড়ি না চালায়, আমরা কি আমাদের দেশের বাস্তবতায় জোর করে গাড়ি নামাতে পারব? আর গাড়ির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা খুব সামান্য মানুষ না, তারা অনেকেই খুব প্রভাবশালী। ব্যস্ত সময়ে যে পরিমাণ বাস-মিনিবাস চলে, সে তুলনায় কম চলছে। জনগণের দুর্ভোগ ও কষ্ট হচ্ছে।’ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজধানীতে মানুষের ভোগান্তির জন্য দায়ী মালিক সমিতির নেতারা। তাদের মধ্যে মন্ত্রীও রয়েছেন। সরকারের দায়িত্ব এ সংকট দূর করা। কিন্তু সরকার খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টি সমাধান করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ, এরসঙ্গে মন্ত্রীদের স্বার্থ জড়িত। জনগণের ভোগান্তি দূর করতে হলে পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করতে হবে। এটা কি সরকার করতে পারবে?’ নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আগে পেছনে চিন্তা না করে যারা হুটহাট অভিযান শুরু করেছে, আমি মনে করি দায়টা তাদেরই। তারা এ ধরনের কাজ করল কেন? আগে পেছনে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, রাজধানীবাসী কী ধরনের দুর্ভোগে পড়তে পারে—তা তাদের ভাবা উচিত ছিল। কোনো কিছুই তারা মাথায় রাখেনি। প্রায়ই যখন মোবাইল কোর্ট বসে, গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়—এটা সবারই জানা। সিটিং সার্ভিস বন্ধের মতো বড় একটি বিষয় নিয়ে যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তখন একটি বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েই মাঠে নামা উচিত ছিল।’ তিনি বলেন, ‘হুজুগে মাঠে নামা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। এক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে আইন প্রণয়নেও একটি সমস্যার সৃষ্টি হবে। তারা যে অপ্রতিরোধ্য, তাদের যে নিয়মের মধ্যে আনা যাবে না সেটা আবারও প্রমাণিত হবে। এর মধ্যে আবার ৪০০ নতুন বাস নামানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য দ্বিগুণ ৮০০ ড্রাইভার আছে কি না, তাদের প্রশিক্ষণ আছে কি না, তাও তো আগে ভাবতে হবে। নতুন বাস নামালেই দুর্ভোগ লাগব হয়ে যাবে বিষয়টি ঠিক নয়। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।’

নারী নেত্রী শিরিন আক্তার এমপি বলেন, ‘এই জটিলতা সৃষ্টির দায় সংশ্লিষ্ট সবার। গণপরিবহনের সংকটের কারণে ঢাকায় আজ নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে দুর্ভোগের শিকার নারীরা। পর্যাপ্ত গাড়ি রাস্তায় না থাকায় মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকছে। আবার অনেকে বাধ্য হয়ে হেঁটে বা বিকল্প ব্যবস্থায় যাতায়াত করছে। গেটলক বলে নরমাল সার্ভিস দিয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আবার সিটিং সার্ভিসের নামে কম দূরত্বে গেলেও বেশি দূরত্বের ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হবে।’

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মনে হচ্ছে মালিকদের স্বার্থই প্রতিষ্ঠিত হবে। ভাড়া কমানোর কথা বলে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা হয়েছে, কিন্তু ভাড়া কমেনি। এটা এক ধরনের ষড়যন্ত্র। সরকারকে বিষয়টি বুঝতে হবে। এখন উল্টো যাত্রীদের মারধর ও বাস থেকে জোর করে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

কৃত্রিম সংকট ভোগান্তিতে যাত্রীরা : সিটিং সার্ভিস বন্ধের চতুর্থ দিনে ‘সিটিং’ ভাড়ায় ‘লোকাল’ হালেই চলছে ঢাকার বিভিন্ন রুটের বাস; বাসের সংখ্যা কম থাকার পাশাপাশি ভাড়া নিয়েও ভোগান্তি কমেনি যাত্রীদের। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পর গত রবিবার থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি-মারামারির ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন স্থানে। বিআরটিএর অভিযানের মধ্যে অনেক মালিক রাস্তায় বাস না নামিয়ে পরিবহনের সংকট সৃষ্টি করেছে। এতে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রীরা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মিরপুর-১২ নম্বর-মতিঝিল রুটে চালু থাকা বাস সার্ভিস বিকল্প অটো, ল্যাম্পস ও হাজী পরিবহনের আগে যেখানে ৫ মিনিটে একটি করে বাস ছাড়ত, সেখানে আধাঘণ্টায়ও একটি বাস ছাড়তে দেখা যায়নি। অনেক গাড়ি গতকাল বন্ধ ছিল। এ ছাড়া রাস্তায় গাড়ি কম থাকায় উত্তরা থেকে মহাখালী হয়ে গুলিস্তান ও যাত্রাবাড়ী এবং উত্তরা থেকে অন্যান্য রুটে সাধারণ দিনের মতো যানজট দেখা যায়নি।  মিরপুর-১২ নম্বর-ফার্মগেট রুটের বিহঙ্গ পরিবহনকে গতকালও দেখা গেছে আগের মতোই সিটিং সার্ভিস চালাতে। যাত্রীরা অসন্তোষ জানালে বাস কন্ডাক্টর রহমত তার মালিকের কোনো নির্দেশনা না পাওয়ার কথা জানিয়ে বলেছেন, আমরা সিটিং—এই চলব। যাত্রীদের কাছ থেকে ‘সিটিং ভাড়া’ রাখা হলেও পথে পথে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা আগের চেয়ে বেড়েছে।

যাত্রীরা অভিযোগ করেন— সিটিং ভাড়া রাখা হচ্ছে, কিন্তু যাত্রী নিয়েছে লোকালের মতো করে। আগের  থেকেও খারাপ অবস্থা। গতকালও বিহঙ্গে লোকাল ভাড়া রাখা হয়েছিল, আজকে (গতকাল) থেকে তারা আবার নতুন নিয়ম করেছে। সকাল সাড়ে ১১টায় পল্টন মোড়ে বন্ধন পড়িবহনের যাত্রী শফিকুর রহমান বলেন, কাজী পাড়া থেকে পল্টন আসতে ভাড়া আগেও ২২ টাকা দিতে হতো, এখনো তাই। তবে স্বস্তির কথা হচ্ছে অন্যদিন আমি সকাল ৯টায় বাসা থেকে বের হলে ১১টা-সাড়ে ১১টা বেজে যেত, আর সেই একই রাস্তা পৌনে ১১টায় কাজীপাড়া  থেকে বাসে উঠে সাড়ে ১১টায় পল্টন  নেমেছি। দুপুর ১২টায় ফার্মগেটে আরিফ নামের এক যাত্রী বলেন, পল্টন থেকে ফার্মগেট আসতে লেগেছে ২০ মিনিট। যানজটের কথা চিস্তা করে আমি আরও আধাঘণ্টা বেশি সময় হাতে নিয়ে বের হয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তায় যানজট নেই।

সর্বশেষ খবর