বিমানের রাডার কেনার দুর্নীতি মামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ তিন আসামির সবাইকে খালাস দিয়েছে আদালত। গতকাল বিকালে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. কামরুল হোসেন মোল্লা রায় ঘোষণা করে এ আদেশ দেন। খালাস পাওয়া অপর দুই আসামি হলেন বিমানবাহিনীর সাবেক দুই প্রধান সুলতান মাহমুদ ও মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। এ ছাড়া মামলার অপর আসামি ইউনাইটেড ট্রেডার্সের পরিচালক এ কে এম মুসা মামলার বিচার চলাকালে পলাতক অবস্থায় মারা যান। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় এরশাদের আইনজীবী শেখ মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আজ দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। এটি একটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ মামলা। মামলায় এরশাদ সুবিচার পেয়েছেন। রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে এরশাদ নির্দোষ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে দুদক এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গতকাল বিকাল ৩টা ৪২ মিনিটে আদালত কক্ষে আসেন। এ সময় এরশাদের ভাই জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের, পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার এবং বর্তমান পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা তার সঙ্গে ছিলেন। পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, কাজী ফিরোজ রশীদ ও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা আগে থেকেই আদালত কক্ষে হাজির ছিলেন। আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর কালো সাফারি পরিহিত এরশাদকে আসামির কাঠগড়ার পাশে একটি চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার শুরুতে তিনি নির্বিকার ছিলেন। রায়ের পরও তিনি কোনো কথা বলেননি। রায় ঘোষণার পর ৪টা ২০ মিনিটে আদালত অঙ্গন ত্যাগ করেন তিনি। আসামি সুলতান মাহমুদকে রায়ের পর নীরবে কাঁদতে দেখা যায়। অশ্রুসিক্ত অবস্থায় তিনি কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অপর আসামি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এ রাজনৈতিক মামলায় বিনাদোষে তিনি হয়রানির শিকার হয়েছেন। রায় ঘোষণা উপলক্ষে দুপুর থেকেই জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা আদালত এলাকায় আসতে শুরু করেন। পুরান ঢাকার নর্থসাউথ রোড থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এরশাদের সমর্থনে নেতা-কর্মীরা রাস্তায় স্লোগানমুখর মিছিল করেন। এ সময় রায়ের সাহেববাজার মোড়সহ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আদালত এলাকায় সকাল থেকেই পুলিশ কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা জোরদার করে। মোতায়েন করা হয় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিপুলসংখ্যক সাদা পোশাকের পুলিশ।
রায়ে বলা হয়েছে : রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে কথিত রাডার কেনার বিষয়ে অর্থ আত্মসাৎ বা কাউকে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। ফলে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তা ছাড়া মামলার অপর দুই আসামি বিমানবাহিনীর সাবেক দুই প্রধান সুলতান মাহমুদ ও মমতাজ উদ্দিন আহমেদ আলোচ্য রাডার ক্রয়ের বিষয়ে কোনো অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বা অপর কাউকে সহায়তা করার বিষয়টিও সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রমাণিত হয়নি। তা ছাড়া সাক্ষ্য-প্রমাণে যেহেতু প্রতীয়মান হয়েছে যে, উল্লিখিত রাডার ক্রয়ের বিষয়ে মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনের আলোকে প্রতিরক্ষা সচিব সুপারিশসহ উপস্থাপিত সার-সংক্ষেপ মোতাবেক সাবেক রাষ্ট্রপতি শুধু ফরমাল অনুমোদন প্রদান করেছেন সেহেতু সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুমোদন প্রদানের ক্ষেত্রে ক্ষমতার কোনোরূপ অপব্যবহার করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। যেহেতু বিষয়টি রাষ্ট্রপতির অনুমোদিত হয়েছে সেহেতু ওই বিষয়ে অপর দুই আসামির আর কোনো দায়দায়িত্ব বর্তায় না। তাই রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে এরশাদসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে মামলার দায় থেকে সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হলো। রায়ে আরও বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি দুদক। রাডার ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির প্রস্তাব শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে এরশাদ অনুমোদন দেন।
মামলা সমাচার : সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের ৪ মে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো এ মামলা দায়ের করে। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ফ্রান্সের থমসন সিএসএফ কোম্পানির ‘অত্যাধুনিক’ রাডার না কিনে বেশি দামে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ওয়েস্টিন হাউসের রাডার কিনে আসামিরা রাষ্ট্রের ৬৪ কোটি ৪ লাখ ৪২ হাজার ৯১৮ টাকা আর্থিক ক্ষতি করেছেন। ঘটনার তদন্ত করে ১৯৯৪ সালের ২৭ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল হয়। পরে এ মামলার আসামি ইউনাইটেড ট্রেডার্সের পরিচালক শাহজাদ আলীকে অব্যাহতি দিয়ে ১৯৯৫ সালের ১২ আগস্ট এরশাদসহ চার আসামির বিচার শুরু করে আদালত। পরে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম সুপ্রিম কোর্টের আদেশে স্থগিত থাকে। আইনি বাধা কাটলে ২০১০ সালের ১৯ আগস্ট শুরু হয় সাক্ষ্য-গ্রহণ। ২০১৪ সালের ১৫ মে এ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের দিন নিজেকে নির্দোষ দাবি করে লিখিত বক্তব্য দেন বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ। সেদিন অন্য দুই আসামি বিমানবাহিনীর সাবেক দুই শীর্ষ কর্মকর্তা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও সুলতান মাহমুদও নিজেদের নির্দোষ দাবি করে বক্তব্য দেন।জাতীয় পার্টির সন্তোষ প্রকাশ : রাডার কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে দুই যুগ আগের মামলা থেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদসহ সব আসামি খালাস পাওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন দলের নেতা-কর্মীরা। পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, এইচ এম এরশাদ নির্দোষ এটা প্রমাণ হয়েছে। ষড়যন্ত্র করে সাবেক এ রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য এ মামলা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রায় দুই যুগ ধরে তাকে হয়রানি করা হয়েছে। তিনি বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সারাটা জীবন দেশবাসীর স্বার্থে কাজ করেছেন। নির্দোষ প্রমাণ হওয়ায় রাজনৈতিকভাবে আমরা আরও এগোতে পারব।