শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সমস্যার শেষ নেই ঢাকায়

সমস্যার শেষ নেই ঢাকায়

খোঁড়াখুঁড়িতে দীর্ঘদিন বেহাল মৌচাক-মালিবাগ সড়ক, গ্যাসের চুলার ওপর কেরোসিনের স্টোভে চলে রান্না, বাসাবাড়িতে মিলছে না সুপেয় পানি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

খোঁড়াখুঁড়িতে রাজধানী ঢাকার অবস্থা এখন ভয়াবহ। এর ওপর চলছে গ্যাসের তীব্র সংকট। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পানির সমস্যা। অথচ নগরবাসী ট্যাক্স দিয়েও পাচ্ছে না ন্যূনতম নাগরিক সেবা। মশা নিধন কার্যক্রমও বন্ধ। সব মিলিয়ে ঢাকা এখন সমস্যা নগরী। এ নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন— মাহমুদ আজহার, গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম রনি

 

হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এখন ঢাকাবাসী। সংস্কার কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে চরম দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে কয়েক দিন ধরেই গণপরিবহনে চলছে কৃত্রিম সংকট। সিটিং সার্ভিস বাস চালু হলেও দুর্ভোগ এতটুকুও কমছে না। ভাড়া বাড়ানোর কৌশল হিসেবে কিছু দিন পরপরই কৃত্রিমভাবে এ সংকট তৈরি করার অভিযোগ রয়েছে। নগরবাসী হোল্ডিং ট্যাক্স দিয়েও বঞ্চিত হচ্ছে সেবা থেকে। এমনকি জন্ম নিবন্ধন পেতেও ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা আর ধুলাবালি তাদের নিত্যসঙ্গী। এর ওপর আছে মশার উৎপাত। মশক নিধন কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে কিছু দিন ধরে। এখানেই শেষ নয়, গ্যাস সংকটের কারণে রাজধানীবাসীর জীবনযাত্রা অচল হওয়ার দশা। প্রতিদিন সকাল ৮টার পরেই গ্যাস চলে যায়। সারা দিন গ্যাসের দেখা মেলে না। মাঝে-মধ্যে পাওয়া গেলেও চুলা জ্বলে টিপটিপ করে। ফলে সকাল-দুপুরের রান্না সবাইকে রাতেই করতে হয়। কেউ কেউ রান্না করেন গভীর রাতে গ্যাস এলে। সংকট শুধু গ্যাসেই নয়, পানির জন্যও হাহাকার বিভিন্ন এলাকায়। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের সামনে থেকে কলেজ গেট পর্যন্ত রাস্তাটি খুঁড়ে ওয়াসা স্যুয়ারেজ পাইপ বসিয়েছে প্রায় ছয় মাস হলো। কিন্তু দীর্ঘদিনেও রাস্তাটির কার্পেটিং না হওয়ায় চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বিকল্প হিসেবে মানুষ আওরঙ্গজেব ও তাজমহল রোড ব্যবহার করলেও গত মঙ্গলবার থেকে ওই সড়কেও স্যুয়ারেজের পাইপ বসানোর কাজ শুরু করেছে ওয়াসা। দুর্ভোগের শেষ নেই সাধারণ মানুষের। রাজধানীর দুঃখ বলা হয় মৌচাক-মালিবাগ এলাকাকে। ফ্লাইওভার নির্মাণ কার্যক্রম ঘিরে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে যাত্রীসাধারণকে। শাহজাদপুর এলাকায় একপাশের রাস্তা কেটে রাখা হয়েছে। প্রায় এক মাস ধরে পুরো এলাকায় দিন-রাত যানজট লেগেই থাকে।  রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলির রাস্তাঘাট পর্যন্ত বেহালদশায় পরিণত হয়েছে। ভাঙাচোরা, খানাখন্দপূর্ণ রাস্তাঘাট এখন রাজধানীর অন্যতম সমস্যা। বাসাবাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে পা রাখার যেন উপায় নেই। নানা সেবা সংস্থার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, মেরামতের নামে সড়কে পিচ-সুরকি ফেলে রাখা আর পানি জমে কাদা-আবর্জনার পিচ্ছিল সরোবর রাস্তাঘাট যেন নাগরিকদের নিত্য নিয়তি। বাড্ডা-ভাটারা এলাকার অনেক রাস্তা দিনের পর দিন একহাঁটু নোংরা পানিতে নিমজ্জিত থাকায় কোনটা রাস্তা আর কোনটা ড্রেন-নর্দমা তা মানুষ ভুলে যেতে বসেছে।

সরেজমিন রাজধানীর সবুজবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, গুলশান-বনানী, তেজগাঁও এলাকা ঘুরে অধিকাংশ ওয়ার্ডে রাস্তাঘাটের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি দেখা গেছে। ভাঙা রাস্তা, ময়লার স্তূপ, জলাবদ্ধতা, মশার উৎপাতসহ নানা সমস্যার বিষয়ে নগরবাসী অভিযোগ করলেও কোনো ফল মিলছে না। রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকাতেও রাস্তাঘাটের বিপন্ন দশা চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।

বেহাল যাত্রী ছাউনি, নগরবাসীর দুর্ভোগ : রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনের যাত্রী ছাউনিতে ভাজাপোড়া খাবার বিক্রি করছে। যাত্রীদের দাঁড়ানোর স্থান নেই। সিরামিকের তৈরি বসার জায়গা থাকলেও উপরে ছাদ নেই ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের উল্টো দিকের যাত্রী ছাউনিতে। সেখানে বেওয়ারিশ কুকুরের বসবাস। পথচারীরা এই কুকুরের ভয়ে অনেক সময় ফুটপাথ ছেড়ে মূল সড়ক দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। গুলিস্তানে স্টেডিয়ামের উল্টো দিকে বাসস্টপেজের সামনের যাত্রী ছাউনির পুরোটাই হকারদের দখলে। কাকরাইল মোড়ের দিকে যাওয়ার পথে শান্তিনগরের যাত্রী ছাউনির উপরে ছাদ নেই। বসার জায়গা নেই শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের দুটি ছাউনিতেই। মিরপুর বাঙলা কলেজের সামনের যাত্রী ছাউনিতে বসলে দুর্গন্ধে টেকা যায় না। এমন দৃশ্য রাজধানীর প্রায় সব যাত্রী ছাউনিরই। এগুলোতে নেই নজরদারি, রক্ষণাবেক্ষণ বা দখলদার উচ্ছেদের ব্যবস্থা।

এবার লোকালও সিটিং : রাজধানীর সব বাস সিটিং সার্ভিসে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য আগে হাফ ভাড়া ছিল, এখন সেই সুযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সিটিং সার্ভিসের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা স্থগিত হওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন রুটে প্রচুর বাস চলাচল করছে। এতদিন বিভিন্ন স্থানে এসব বাস লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। নতুন-পুরাতন এমনকি লক্কড়-ঝক্কড় বাসও দিব্যি যাত্রী পরিবহন করে চলেছে। তবে ভাড়া আদায়ে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে যেভাবে পারছে মনগড়া সার্ভিস দেখিয়ে ভাড়া আদায় করছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।

রাজধানীর মিরপুর থেকে সিটিং বাসগুলো আগের মতো ভাড়া নিচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। ভাড়ার চার্ট গাড়িতে প্রদর্শনের কথা থাকলেও তা দেখা যায়নি। যাত্রীদের অভিযোগ, গত কয়েক দিনে বিআরটিএ যে অভিযান চালায় তার ফলে যাত্রীদের কী সুবিধা হলো, কার স্বার্থে এ অভিযান ছিল যাত্রীদের মুখে মুখে এখন এমন প্রশ্ন। রাশেদুল ইসলাম বলেন, রাস্তায় গাড়ি বেড়েছে, কিন্তু সিটিং সার্ভিস আবারও শুরু হয়েছে। অন্য এক যাত্রী বলেন, এভারেস্ট নামের গুলিস্তানগামী বাসে সকালে দেখলাম ভাড়া আগের অবস্থায় ফিরেছে। মিরপুর থেকে ফার্মগেটের ভাড়া নিয়েছে ১৫ টাকা। বাসে ভাড়ার চার্টও নেই। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়া পাঁচ টাকা। কিন্তু ট্রান্সসিলভা ট্রান্সপোর্ট ও ৮ নম্বর মিনিবাসে ১০ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। অথচ বিগত কয়েক দিন বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত সক্রিয় থাকায় এসব কোম্পানির বাস কিছুটা কম ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করছে। এখন কোনো রাখঢাক না করে প্রকাশ্যেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ট্রান্সসিলভা পরিবহনের হেলপার বলেন, মালিকরা যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছেন আমরা সেই ভাড়াই আদায় করছি। তবে ভাড়া নিয়ে বাসের ভিতর যাত্রীদের সঙ্গে হেলপারদের ঝগড়াও যথারীতি চলছে। অন্যদিকে মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিলগামী দীপন বাস সার্ভিস আবার সিটিং সার্ভিস চালু করেছে। তবে তারা ভাড়া বাড়ায়নি। শিক্ষার্থীদের জন্য আগে হাফ ভাড়া ছিল, এখন সেই সুযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সর্বনিম্ন ভাড়া নেওয়া হচ্ছে আগের মতো ১০ টাকা। উল্লেখ্য, রাজধানীতে ১৬ এপ্রিল থেকে গণপরিবহনে সিটিং, গেটলক ও স্পেশাল বাস সার্ভিস বন্ধ করা হয়। বিষয়টি তদারকি করতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। রাজধানীর পরিবহন খাতে অনিয়মের অভিযোগে সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। কিন্তু মালিকদের চাপে গত বুধবার বিআরটিএ সিটিং সার্ভিস ও গেটলকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ১৫ দিনের জন্য স্থগিত করে। 

রাজস্ব দিয়েও মিলছে না সেবা : রাজস্ব দিয়েও ন্যূনতম সেবা পাচ্ছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দারা। জন্ম নিবন্ধন থেকে মৃত্যুসনদ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই চলছে দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি আর ভোগান্তি। টাকা ছাড়া মিলছে না নাগরিক সনদও। এমনকি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ নাগরিকরা।  ঢাকার দুই সিটির কয়েকটি ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়েও দেখা মেলেনি কর্মকর্তাদের। তবে অফিসে ভিড় করতে দেখা যায় সাধারণ নাগরিকদের। বিভিন্ন কাজে তারা এসেছেন। কর্মকর্তা না থাকায় তারা বসে আছেন। দালাল গোছের কিছু লোক অনেককেই প্রশ্ন করছেন— কী লাগবে? নাগরিক সনদ, না জন্ম সনদ? তবে তারা তাদের পরিচয় কাউকে দিচ্ছেন না। আর এভাবেই প্রতিদিন দালালের খপ্পরে পড়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নাগরিকরা। বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন শত শত লোক ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়ে সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আর সেই সুযোগে কাউন্সিলর কার্যালয়গুলোতে নাগরিক সনদ ও জন্ম সনদ দেওয়ার নামে একটি চক্র বাণিজ্য শুরু করেছে। ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা করে নিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটি সনদ।

মশক নিধন বন্ধ : শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত মশক নিয়ন্ত্রণের কীটনাশক দিয়ে লাভিং সাইডিং এবং বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উড়ন্ত মশা নিধন কার্যক্রম চালানোর কথা থাকলেও তা হচ্ছে না বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। প্রতিদিন মশক নিধন কার্যক্রম চলার কথা থাকলেও সরেজমিন ঘুরে কোথাও মশক নিধন কার্যক্রমের দেখা মেলেনি। এদিকে মশার উপদ্রব নগর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মশা দমন, মশক প্রজনন স্থল, যেমন— ডোবা, নালা, বিল, ঝিল, নর্দমা নিয়মিত কীটনাশক ছিটানোর কথা থাকলেও সেসব বিষয় সিটি করপোরেশন শুধু বক্তৃতা, সেমিনার, লিফলেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। উত্তরার বাসিন্দা মুকুল প্রধান বলেন, মশা নিধনে সিটি করপোরেশন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এলাকায় দেড়-দুই বছরেও মশার ওষুধ ছিটানোর নজির দেখতে পাচ্ছি না। সন্ধ্যা হতে না হতেই ঝাঁক ঝাঁক মশা আসে।

চলছে জাল সনদের ব্যাণিজ্য : দুই ডিসিসি কার্যালয় ঘুরে কোনোটিতেই কাউন্সিলরদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে অসাধু ব্যক্তিরা কাউন্সিলরের স্বাক্ষর জাল করে সনদ দিচ্ছে। আবার কোনো কোনো কার্যালয়ের স্টাফরা টাকার বিনিময়ে কাউন্সিলরের কাছ থেকে সনদ এনে দিচ্ছেন। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, নাগরিকত্বের সনদের জন্য লোকজন ওয়ার্ড অফিসগুলোতে ভিড় করবে, এটাই স্বাভাবিক।

ওভারপাস-আন্ডারপাসের যন্ত্রণা : রাজধানীর বেশির ভাগ ওভারব্রিজ দীর্ঘদিন ধরেই বেদখল হয়ে আছে। ভিক্ষুক, পটেকমার, হকার ও বখাটেদের দখল কায়েম থাকায় পথচারীরা সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এসব ভোগান্তির পাশাপাশি নতুন মাত্রা সংযোজন হয়েছে উলঙ্গ পাগলদের উৎপাত। অধিকাংশ ওভারব্রিজে দৃশ্যত সিটি করপোরেশনের আদৌ কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তৎপরতা নেই পুলিশেরও। চলাচলের ক্ষেত্রে পথচারীরা ওভারব্রিজ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকাটাই নিরাপদ মনে করেন। অন্যদিকে আন্ডারপাসগুলো এখন শতেক জঞ্জালে ঠাসা। রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে পথচারীরা পোহাচ্ছেন সীমাহীন ভোগান্তি। বজায় থাকছে না নিরাপত্তা। বিদ্যুৎ চলে যেতেই কারওয়ানবাজারের আন্ডারপাস পরিণত হয় অন্ধকার গুহায়। সেখানে মহিলারা শিকার হচ্ছেন নানা লাঞ্ছনার। গাবতলীর আন্ডারপাস থাকে পকেটমারদের দখলে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর