শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

গ্যাস-পানি সংকটে হাহাকার

গ্যাস-পানি সংকটে হাহাকার

রাজধানীতে পানি আর গ্যাস সংকটে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে না নগরবাসীর। অনেক এলাকায় রাত থেকে ভোরের মধ্যে রান্নার কাজ সারেন গৃহিণীরা। দিনভর দেখা মেলে না গ্যাসের। একই অবস্থা পানিরও। অনেক এলাকায় দিনের বেলায় গোসল বা বাথরুমে যাওয়া যায় না। কারণ, দিনের বেলায় পানি থাকে না। কোনো কোনো এলাকায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পানি নেই। রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়া ও বনফুল এলাকায় এক মাস ধরে পানির জন্য হাহাকার চলছে। এলাকার কয়েক হাজার মানুষের দৈনন্দিন জীবন অনেকটাই স্থবির। হাতির ঝিল সংলগ্ন মধুবাগ এলাকায় একটি পানির পাম্প সংস্কারের জন্য বন্ধ করে রাখা হয়েছে প্রায় ১৬ দিন। ফলে ওই এলাকার কয়েক শ বাড়িতে পানি সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। মিরবাগ এলাকার রবিউল ইসলাম অভিযোগ করেন, প্রায় ১৫ দিনের বেশি হয়ে গেল এলাকায় পানি নেই। এ এলাকার কিছু বাড়ির মালিক মাঝেমধ্যে ওয়াসার গাড়ির পানি কিনে এনে সরবরাহ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। বাইরে থেকে মিনারেল ওয়াটার কিনে অনেকে গৃহস্থালির কাজকর্ম সারছেন। এ প্রসঙ্গে ওয়াসার এমডি তাসকিম এ খান জানান, ‘আমরা ৭০০ ডিপ টিউবওয়েলের ওপর নির্ভরশীল। বছরের এই সময়টাতে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। এ কারণে পানির পাম্পগুলোয় উৎপাদন কমে যায়। ফলে পানির সংকট দেখা যায়। এটা সাময়িক।’

জানা যায়, পানির তীব্র সংকটে অনেক বাড়ির ভাড়াটিয়া বাসা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন বাড়িওয়ালারা। অনেক বাড়িওয়ালা ওয়াসা থেকে পানির গাড়ি কিনে এনে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। হাতির ঝিল এলাকার রুপা ইসলাম নামে এক গৃহকর্ত্রী বলেন, ‘খাওয়ার পানি কিনে আনলেও গৃহস্থালি ও গোসলের পানির জন্য এলাকায় হাহাকার চলছে। এভাবে চলতে পারে না।’ হাতির ঝিল মধুবাগ ব্রিজে পানির পাম্পে সব সময় পানির জন্য দীর্ঘ লাইন লেগেই থাকে। গতকাল সকালেও প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় পানি নিতে আসা স্কুলছাত্র গোলাম কিবরিয়া ও শফিকুল ইসলামের। তারা থাকে মিরবাগের একটি বাসার নিচতলায়। তারা জানাল, বাবা আমিনুল ইসলাম সবজি ব্যবসায়ী ও মা রাফিয়া খাতুন গার্মেন্টে চাকরি করেন। তারা দুজনই সকালে বাসা থেকে বের হয়েছেন কাজে। সে কারণে স্কুলে যাওয়ার আগে তারা দুই ভাই পানি সংগ্রহ করতে এখানে এসেছে। পানির জন্য হাহাকার করছেন রাজধানীবাসী। অনেক এলাকায় পানির সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও পানিতে রয়েছে শ্যাওলার গন্ধ। পানির সঙ্গে আসছে ময়লাও। অনেক পাম্পে কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া, পানির লাইন উঁচু-নিচু হওয়া, সুয়ারেজ লাইনে সমস্যাসহ নানা কারণেই পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। পানির এমন তীব্র সংকট দেখা দিলেও সমাধানে ওয়াসা কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়া ও বনফুল এলাকায় এক মাস ধরে পানির সংকট চলছে। কোনো সমাধান হচ্ছে না। আশপাশ এলাকার বাড়ি থেকে পানি এনে চলছে রান্নার কাজ। ঢাকা ওয়াসা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বার বার জানিয়েও মেলেনি ফল। মগবাজারে ব্যাপারী গলিতে পানি আসে গভীর রাতে, তাও মাত্র আধা ঘণ্টার জন্য। চরম দুর্ভোগ এই এলাকায়ও। পানির তীব্র সংকট রয়েছে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, কলাবাগান, রামপুরা, বাড্ডা, কুড়িল, শাহজাদপুর ও পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার বিভিন্ন অংশে। সূত্রমতে, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীতে পানির নতুন লাইন স্থাপন করলেও শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করছে তাতে দুর্গন্ধ। অনেক সময় কালো ও লালচে রঙের পানি আসে। ফোটালেও পানির দুর্গন্ধ যেতে চায় না, ফেনা হয়। হাত-মুখ ধুলে চোখ জ্বলতে থাকে। বাইরে থেকে বোতলজাত পানি কিনে খেতে হচ্ছে। আর যারা বেশি টাকা দিয়ে কিনতে পারছেন না তাদের এই নোংরা পানি খেয়ে পেটের পীড়াসহ নানা অসুখে ভুগতে হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে, বর্তমানে রাজধানীতে ওয়াসার প্রায় চার লাখ গ্রাহক রয়েছেন। এসব গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন ২৩০ থেকে ২৩৫ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন হয়। তবে ওয়াসার সক্ষমতা রয়েছে আরও বেশি। ওয়াসা বর্তমানে ২৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করতে পারে। ওয়াসার সিস্টেম লস রয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর মধুবাগ, হাতির ঝিল পাড়, হাজী চান মিয়া লেন, মিরবাগ, নয়াটোলা, পেয়ারাবাগসহ মগবাজারের বেশির ভাগ অংশেই পানির জন্য হাহাকার করছেন বাসিন্দারা। সেখানে ওয়াসার লাইনে দিনে, রাতে কোনো সময়ই পানি আসছে না। রান্না, খাওয়া দূরের কথা, বাথরুমে যাওয়ার মতো পানিও পাচ্ছেন না তারা। কেউ কেউ মিনারেল ওয়াটার কিনে পানির আপাত সমস্যা সমাধান করলেও নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জীবন চালানোই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই গোসল ও কাপড় কাচার জন্য চলে যাচ্ছেন দৃষ্টিনন্দন হাতির ঝিলে। পুরান ঢাকার আরমানিটোলার বাসিন্দা সুজন শেখ বলেন, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। প্রায় দিনেই ভোর সাড়ে ৫টা থেকে কিছু সময় এবং সন্ধ্যার পর অল্প সময়ের জন্য পানি আসে। গোরানের বাসিন্দা ইমতিয়াজ বুলবুল বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে এ এলাকায় পানির সংকট চলছে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে পানি আসে, কিন্তু তা দুর্গন্ধযুক্ত। এ পানি ফোটালেও দুর্গন্ধ থাকে। বুধবার ফকিরাপুল পানির ট্যাংকের সামনে দেখা যায় মানুষের ভিড়। ৮ থেকে ১২ বছরের শিশু এবং নারী-পুরুষ পানি সংগ্রহ করতে হাঁড়ি-কলসসহ বিভিন্ন ধরনের পাত্র নিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।

গ্যাস আছে গ্যাস নাই : ভাটারার ছোলমাইদ এলাকার গৃহিণী রহিমা খাতুন। ভোর রাতেই তিনি রান্নার কাজ সারেন। তার বাসায় প্রতিদিনই সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। আবার বেলা ৩টার পর গ্যাস এলেও চুলা জ্বলে নিবু নিবু। রাত ১০টার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গ্যাস থাকে। তার মতো অনেক গৃহিণীই রান্না করেন ভোর রাতে।

জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুর, কাফরুল, কাজিপাড়া, মোহাম্মদপুর, কাঁঠালবাগান, মুগদা, সেগুনবাগিচা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মগবাজার, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় চলছে তীব্র গ্যাস সংকট। বিশেষ করে মিরপুরে গ্যাস সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে। গ্যাস সংকটে একদিকে যেমন নতুন শিল্প কারখানাগুলো দাঁড়াতে পারছে না, অন্যদিকে গ্যাসের অভাবে বন্ধ হতে চলেছে উৎপাদনমুখী কল কারখানাগুলো। গ্যাস সংকটের কারণে কল কারখানার উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। উৎপাদন ঘাটতির পাশাপাশি অবৈধ সংযোগ ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে রাজধানীতে গ্যাস সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গ্রাহক চাহিদা পূরণ করতে পারছে না গ্যাস কোম্পানি। নগরীর প্রায় ২০টি এলাকার সাড়ে আট লাখ গ্রাহক তীব্র গ্যাস সংকটের মুখে পড়েছেন। দিনের অধিকাংশ সময় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকায় গৃহস্থলির কাজে যেমন সীমাহীন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে; তেমনি গ্যাসচালিত পরিবহন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসাসহ শিল্প কারখানার উৎপাদনে ব্যাপক ভাটা পড়েছে। এ নিয়ে চরম বিপাকে আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকরা। গ্রাহক চাহিদা পূরণ করতে পারছে না তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। রাজধানীতেই দেড় শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ঘাটতি রয়েছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের দাবি, নগরীতে দৈনিক ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যয় হলেও পুরোপুরি উৎপাদন নেই। তবে চাহিদার কাছাকাছি সরবরাহ করা হচ্ছে দাবি করা হয়। জানা গেছে, এখনো প্রায় দেড় শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে রাজধানীতে। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মুনসুর, মো. ফয়েজউল্লাহ বলেন, ‘অবৈধ সংযোগ ও অপরিকল্পিত নগরায়ণই গ্যাস সংকটের অন্যতম কারণ।’ জানা যায়, রাজধানীতে বৈধ গ্যাসের সংযোগ রয়েছে ২৩ লাখ ৫ হাজার ২৩১টি। আর অবৈধ সংযোগ ২ লাখেরও বেশি। এ ছাড়া নাগরীর বিভিন্ন সেক্টরে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। পেট্রোবাংলা জানায়, বৈধ আবাসিক সংযোগে প্রতিদিন গ্যাস ব্যবহূত হয় ২৪ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট; যা মোট উৎপাদিত গ্যাসের ১২ শতাংশ। আর বর্তমান আবাসিক খাতে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ২৭ কোটি ঘনফুট। অবৈধ সংযোগ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে গ্যাস সংকট থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ খবর