শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সুইচ চাপলেই কড়কড়ে টাকা

নগরীতে জাল টাকার সিন্ডিকেট, আবাসিক বাসায় কারখানা

সাখাওয়াত কাওসার

সুইচ চাপলেই কড়কড়ে টাকা

পাশাপাশি দুটি কক্ষ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে টাকার বান্ডিল। ২০০০, ১০০০ এবং ৫০০ টাকা ও ভারতীয় রুপির বান্ডিল। দুটি কক্ষেই শুধু টাকা আর টাকা। আরও পড়ে আছে ২০ রঙের কার্টিজ, প্রচুর কাগজ, প্রিন্টার, কম্পিউটারসহ বিশেষ কিছু যন্ত্রপাতি। প্রিন্টারের ওপরও নতুন কড়কড়ে টাকা। সুইচ টিপলেই যেন বেরিয়ে আসছে এই নতুন টাকাগুলো। না এটি কোনো টাকশাল নয়। রাজধানীর আদাবরের  মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের ১১ নম্বর সড়কের ১৫/১ নম্বরের একটি ভবন। ওই ভবনের একটি ফ্ল্যাটে গড়ে তোলা হয়েছে এমনই জাল মুদ্রা তৈরির কারখানা। যা গোয়েন্দারা আবিষ্কার করেছেন গত ১৭ এপ্রিল। শুধু আদাবরের এই বাসাটি নয়, এ ধরনের অন্তত ২০টি কারখানা ছড়িয়ে রয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কাজ করছে অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রুপ। রীতিমতো বেপরোয়া হয়ে উঠছে জাল মুদ্রার কারিগররা। এত দিন দেশের বাইরে থেকে আসা ভারতীয় জাল রুপি বিভিন্ন সময় বিমানবন্দরে ধরা পড়লেও এবার খোদ রাজধানীতেই কারখানা বানিয়ে বসেছে তারা। অভিজাত গুলশান, নিকেতন এলাকায়ও রয়েছে তাদের বিচরণ। কারখানায় শুধু দেশীয় টাকা নয়, ভারতীয় রুপিসহ বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রা তৈরি করছে এই সিন্ডিকেট। ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশ-বিদেশে। ডিবি পুলিশ জানায়, সোমবার দিবাগত রাতে ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. শাহ্জাহান এবং জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার গোলাম সাকলায়েন ছদ্মবেশে এই বাড়িতে প্রবেশ করেন। জাল নোট তৈরির এসব দৃশ্য এবং জাল এসব ভারতীয় মুদ্রার মান দেখার পর রীতিমতো চোখ কপালে উঠে যায় গোয়েন্দাদের। এক পর্যায়ে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে যাবতীয় মালামাল জব্দসহ জাল নোট সিন্ডিকেটের বুলবুল আহাম্মদ, খাইরুল ইসলাম, শামসুল হক, শাহীন আক্তার ও আলমগীর হোসেনকে গ্রেফতার করেন। বিষয়টি জানতে পেরে ওই রাতেই ভারতীয় হাইকমিশনের একজন প্রতিনিধি ছুটে আসেন মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে। তার চোখও রীতিমতো ছনাবড়া। বিশেষ  ধন্যবাদ দিয়ে ত্যাগ করেন ডিবি অফিস। ডিবির (উত্তর) এডিসি মো. শাহ্জাহান জানান, পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ দানিশের ঘনিষ্ঠ সহযোগী গ্রেফতার খাইরুল এবং শামসুল। দানিশ হাতেকলমে তাদের জাল নোট তৈরি শিখিয়েছেন। কাউকে জল ছাপ, কেউ কাগজ কাটা, প্রিন্ট, নিরাপত্তা সুতা লাগানোর কাজ করেন। জব্দকৃত অর্থের পরিমাণ ১৫ লাখ রুপি হলেও উদ্ধারকৃত কাঁচামাল দিয়ে অন্তত ৩০ কোটি রুপির মুদ্রা তৈরি করতে পারতেন তারা। তিনি আরও বলেন, গ্রেফতারকৃতরা পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। জব্দকৃত জাল মুদ্রার কোয়ালিটি এতটাই উন্নত যে আমরা সত্যিই অবাক হয়েছি। আশা করছি, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করা সম্ভব হবে।  ডিবি সূত্র বলছে, সম্প্রতি জাল মুদ্রা ঠেকাতে ভারতে মুদ্রা পরিবর্তন করার পরও থেমে থাকেননি জাল মুদ্রার কারিগররা। ভারতীয় মুদ্রাসহ অন্যান্য দেশের মুদ্রা তৈরির জন্য বিশেষায়িত কাগজ গোপনে বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে সিন্ডিকেট। গ্রেফতারকৃতরা সিন্ডিকেটের তৃতীয় সারির সদস্য বলে দাবি গোয়েন্দাদের। একটি কাগজ দিয়ে চারটি মুদ্রা তৈরি করে থাকেন কারিগররা। জাল নোট তৈরির জন্য কাগজে জলছাপ দেওয়ার জন্য কুষ্টিয়ায় একটি অফিস খুলেছিল খাইরুল-শামসুল সিন্ডিকেট। সেখানে জলছাপ দেওয়া সম্পন্ন হলে ঢাকায় নিয়ে এসে নিরাপত্তা সুতা ঢোকান কারিগররা। চাহিদা অনুযায়ী জলছাপ সংবলিত কাগজ সরবরাহ করা হয় কুষ্টিয়া থেকে। প্রস্তুতকৃত জাল রুপি সীমান্তে গরু কারবারিদের মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ করায় সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ভারতীয় সীমান্তবর্তী প্রতিটি স্থলবন্দরসহ অন্তত ২৫টি পয়েন্ট রয়েছে। এসব সিন্ডিকেটের প্রতিনিধি অবস্থান করছে ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। ওইসব এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য এরই মধ্যে অনুমতি চেয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করেছে ডিবি (উত্তর) বিভাগ। খুব শিগগিরই পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ভারতীয় জাল রুপি তৈরিতে অতীতেও পাকিস্তানের সহায়তা ছিল। ওই দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা সব সময়ই এ বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে। হয় তো তাদের মাধ্যমেই বিশেষায়িত কাগজসহ অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করছে এসব সিন্ডিকেট। জানা গেছে, কোরবানির ঈদ ও দুর্গাপূজার উৎসব সামনে  রেখে রাজধানীতে সক্রিয় জাল টাকার ২৫ সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের সদস্যদের বেশির ভাগ র‌্যাব-পুলিশের হাতে  গ্রেফতারের পর জামিনে মুক্ত হয়ে জাল টাকার জাল বিস্তার করছে। তাদের তৈরি কোটি কোটি টাকা মূল্যমানের জাল নোট অর্ধশতাধিক গ্রুপের মাধ্যমে এরই মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। জাল টাকাগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়,  সেগুলো আসল না নকল তা বোঝা অনেক ক্ষেত্রে মুশকিল হয়ে পড়ে। এসব টাকা কোরবানির পশুর হাটসহ ঈদ-পূজা উৎসবের কেনাকাটায় সুযোগ বুঝে গছিয়ে দেওয়া হবে। একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এমনই আশঙ্কা করা হয়েছে।

যেভাবে ধরা পড়ে ভারতীয় রুপির চালান : ২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি ডিবি পুলিশ ১০ লাখ জাল ভারতীয় রুপিসহ  গ্রেফতার করে ভারতীয় জাল মুদ্রা চক্রের সদস্য দুই পাকিস্তানি নাগরিক মো. দানিশ ও সাব্বির আলী আর তাদের বাংলাদেশি সহযোগী ফাতেমা আক্তারকে। এর আগে ২০০৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর রুবিনা হোসাইন নামের এক পাকিস্তানি নারীকে ভারতীয় মুদ্রাসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। জাল মুদ্রার কারবারি সরফরাজ বাংলাদেশি লতিফা বেগম নামের এক নারীকে বিয়ে করেছেন। সে সময় সরফরাজ কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। সরফরাজ ভারতে জাল মুদ্রা বাজারের একজন বড় নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তিনি ২০০৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর কলকাতায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। দানিশ লাহোরে বাস করলেও বাংলাদেশি ফাতেমা বেগম নামের এক নারীকে বিয়ে করেছেন। ডিবি পুলিশ রামপুরা বাজার থেকে দানিশকে সস্ত্রীক গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে দানিশ আদালত থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে যান। তবে তাদের কাছ থেকে সেই সময়ই ৭ মহিলার সন্ধান মেলে, যারা ভারতীয় জাল মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ওই সময় রুবিনা জানিয়েছিলেন, তিনি প্রতি ট্রিপে দুই কোটি টাকার জাল মুদ্রা আনতেন পাকিস্তানের করাচি থেকে। পরে হোটেলে একজন  দেখা করে মুদ্রাগুলো নিয়ে যেতেন।

ভারতীয় জাল মুদ্রার আরও চালান : ২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি মৌচাক এলাকা থেকে ১০ লাখ টাকার জাল ভারতীয় মুদ্রাসহ সাব্বির নামের অপর এক পাকিস্তানিকে  গ্রেফতার করা হয়। একইভাবে পরদিন রায়েরবাগ এলাকা  থেকে জাহিদ হাসান নামের অপর এক পাকিস্তানি নাগরিক ধরা পড়েন গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। ওই বছরের ৬ জানুয়ারি মোবাশ্বির শাহেদ নামের অপর এক পাকিস্তানি বিপুল পরিমাণ জাল নোটসহ গ্রেফতার হন ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভারতীয় ৪৮ লাখ জাল রুপিসহ  গ্রেফতার করা হয় শামীম নাজ (৪৭) নামের এক পাকিস্তানি মহিলাকে। ২০১৩ সালের ২২ জুন শাহজালাল বিমানবন্দরে ৯০ লাখ টাকার জাল ভারতীয় রুপিসহ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যদের হাতে গ্রেফতার হন পাকিস্তানি নাগরিক ওয়াহিদ আলী (৪০)। এর একদিন পর এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ইকে-৫৮২ ফ্লাইটে বিমানবন্দরে আসা সাদাকাত আলী খান (৪২) নামের অপর এক পাকিস্তানি নাগরিক ৪১ লাখ জাল ভারতীয় রুপিসহ গ্রেফতার হন। তার পাসপোর্টে ভারত-পাকিস্তান ও নেপাল ভ্রমণের ভিসা পাওয়া যায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ ও মিডিয়া শাখার উপপুলিশ কমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, গত তিন বছরে  গোয়েন্দা পুলিশ ৫০ কোটি টাকার দেশি ও বিদেশি মুদ্রা আটক করেছে। এর মধ্যে ১০ কোটি টাকার ভারতীয় মুদ্রা রয়েছে, যার বেশির ভাগই জাল। তিনি বলেন, ভারতীয় জাল মুদ্রা আসছে মূলত পাকিস্তান ও দুবাই থেকে। এই জাল মুদ্রার সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’এর  যোগসাজশ রয়েছে। সংস্থাটি ভারতের ভিতরে জাল মুদ্রা পাঠিয়ে সে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এটাকে এক ধরনের যুদ্ধ বলতে পারেন। ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, জাল মুদ্রার কারিগররা ভারতীয় গরু কেনাবেচায় সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় এসব জাল রুপি ব্যবহার করে। সাতক্ষীরা, যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম সীমান্তেও এই চক্র দীর্ঘদিন ধরে এসব ব্যবসা করে আসছে। তিনি আরও বলেন, জাল নোট চক্রে কোনো পাকিস্তানি নাগরিকের সন্ধান পাওয়া গেলে তাদেরও গ্রেফতার করা হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর