রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

দলাদলিতে বেহাল হাসপাতাল

দুপুর গড়ালেই চিকিৎসক উধাও, মনোযোগী প্রাইভেট ক্লিনিকে, দালালদের দৌরাত্ম্য, জিম্মি রোগীরা

মাহমুদ আজহার, গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম রনি

দলাদলিতে বেহাল হাসপাতাল

হাসপাতালে অতিরিক্ত রোগীর এই চিত্র স্থায়ী রূপ নিয়েছে —ফাইল ছবি

দলাদলিতে বেহাল সরকারি হাসপাতাল। সেবার চেয়ে রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত চিকিৎসকের বড় একটি অংশ। মনোযোগী তারা প্রাইভেট ক্লিনিকে। দুপুর গড়াতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন হাসপাতাল ছাড়তে। আবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকার সমর্থক চিকিৎসকদের দ্বন্দ্ব বরাবরই। এখন স্বাচিপের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অনেক সরকারি হাসপাতালে স্থবিরতা চলছে। চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। সংকট উত্তরণে সরকারের ভূমিকাও যথেষ্ট নয়। শিক্ষানবিশ চিকিৎসকের পাশাপাশি নার্সদের দৌরাত্ম্য আছেই। ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। সরেজমিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতাল, বরিশাল মেডিকেল হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতাল ও রংপুর মেডিকেল হাসপাতালে খোজ খবর নিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। একই অবস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অধিকাংশ হাসপাতালে। তবে ব্যতিক্রমও কিছু রয়েছে। চিকিৎসক আর কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবাও পাচ্ছেন নাগরিকরা। তবে এর সংখ্যা খুবই নগণ্য। 

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় দলাদলি বন্ধ করতে হবে। নানামুখী সংকট উত্তরণে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। চিকিৎসকদের স্বাচিব বা ড্যাবের নামে দলীয় লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।  এটা চিকিৎসা আইনেও নিষিদ্ধ। স্বাস্থ্য খাতে বাড়াতে হবে বাজেট বরাদ্দ। প্রয়োজনীয় লোকবল বাড়ানোর পাশাপাশি উন্নত মানের চিকিৎসা সামগ্রীও থাকতে হবে।  এ প্রসঙ্গে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগে জনগণকে সেবা দিতে হবে। তারপর অবসর সময়ে চিকিৎসকরা অন্য কোথাও বসতে পারেন। এখানে দেখার মূল বিষয় হলো, সরকারি ডিউটি সঠিকভাবে চিকিৎসকরা পালন করছেন কি না। যদি তা না করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

সরকারদলীয় চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ নেতাদের সঙ্গে হাসপাতাল প্রশাসনের গ্রুপিং ও দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে বিএমএ সভাপতি বলেন, ‘তথ্যটি সঠিক নয়। এমন তথ্য যাচাই করা প্রয়োজন। পার্টি করলাম, সরকারি দলের নেতা হলাম বলে জনগণের সেবা বাদ দিয়ে হাসপাতাল প্রশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে সেবাবঞ্চিত করব—এমন মানসিকতা চিকিৎসকদের আছে বলে মনে হয় না।’ এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সনাল বলেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটের পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকে। শুধু পর্যাপ্ত চিকিৎসক থাকলেই স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো যাবে না। এর জন্য চিকিৎসকের পর্যাপ্ত হেলপ সার্ভিসগুলো রাখতে হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রের অনুপাতগুলো ঠিক থাকলে সেবার মানে ব্যত্যয় হবে না। তবে ঢাকা মেডিকেলে স্বাচিপের চিকিৎসক বেশি আছেন ঠিকই, সবাই কাজ ছেড়ে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন এটা সঠিক নয়। শুধু সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকেন। আর বাকিরা তো কাজ করেন। কাজ করেন বলেই তো রোগীরা আসেন। তা না হলে তো রোগীরা আসতেন না।’

জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল প্রশাসন আর স্বাচিপ নেতাদের দ্বন্দ্বে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নিয়োগ, পদোন্নতি, উচ্চশিক্ষার কোর্সে ভর্তি, কেনাকাটা নিয়ে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা। উপাচার্য, উপ-উপাচার্যের বিরোধের পাশাপাশি রয়েছে স্বাচিপ নেতাদের মতদ্বৈধতা। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেইন অব কমান্ড  ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। শিক্ষক-চিকিৎসকরাও বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে দলাদলিতে জড়িয়ে পড়েছেন।

ঢাকা মেডিকেল শুধুই স্বাচিপ : রোগীরা ঠিকমতো দেখা পান না সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের চিকিৎসকদের। ফলে তাদের নির্ভর করতে হয় ইন্টার্নি চিকিৎসক কিংবা নার্স ও ওয়ার্ড বয়ের ওপর। জটিল যে কোনো ধরনের অপারেশনও হয় না ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসকরা ‘দলাবাজি’ আর প্রাইভেট হাসপাতালে সময় দিতেই ব্যস্ত থাকেন। এ ছাড়া ঢামেক হাসপাতালে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) চিকিৎসকদের আধিপত্য-প্রভাব অনেক বেশি। তাই তাদের ওপর কারও নিয়ন্ত্রণও নেই। চিকিৎসক নেতাদের মতে, শুধু চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসাক্ষেত্রের সংকট নিরসন করা যাবে না। এর জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, নার্স ও ওয়ার্ড বয় প্রয়োজন।

জানা গেছে, গত ছয় বছরে দেশের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে প্রায় ২৫ হাজার চিকিৎসক এমবিবিএস পাস করে বের হয়েছেন। বর্তমানে দেশে মোট রেজিস্টার্ড এমবিবিএস চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭৫ হাজার। ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসকদের সম্পর্কে অভিযোগ পাওয়া যায়, এখানকার বেশির ভাগ চিকিৎসক স্বাচিপের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে এ হাসপাতালে স্বাচিপের আধিপত্যও বেশি। এ কারণে অন্য চিকিৎসকরা কোণঠাসা হয়ে থাকেন। এতে দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিৎসকের দেখা পান না সাধারণ রোগীরা। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং পদোন্নতিও পেয়ে থাকেন স্বাচিপের চিকিৎসকরা। যারা পদোন্নতি পান তারা কৃতজ্ঞতার খাতিরে আর অন্যরা পদোন্নতি পাওয়ার আশায় নিজের পেশাগত কাজের চেয়ে দলের কাজে ব্যস্ত থাকেন। আর সময়ও দেন বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত নেতাদের পেছনে। অধিক টাকার লোভে দলের কাজের পাশাপাশি প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী দেখার জন্য সময় বের করেন তারা। আর বড় কোনো ধরনের অপারেশনের রোগী ঢামেক হাসপাতালে থাকলে তাকে প্রাইভেট হাসপাতালে স্থানান্তর করেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। ঢামেক সূত্র জানায়, সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির চিকিৎসক, নার্স, আয়া-কর্মচারীর দুর্ব্যবহারে রোগীরা চরম অসহায়। এ জন্য বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে উন্নত চিকিৎসা আর ভালো ব্যবহারের নামে চলে ‘গলাকাটা বাণিজ্য’। এ বাণিজ্য চলে ঢামেকের নিউরো সার্জারি বিভাগে পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে দক্ষ চিকিৎসকের অভাবে ভুগছে বিভাগটি। স্বাচিপ করেন না এমন চিকিৎসকদের এ বিভাগে যোগ দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ঢামেকের একাধিক চিকিৎসক জানান, আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতার পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন সাংগঠনিক দলাদলির ধকল পোহাতে হয় তাদের। বছরজুড়েই চলতে থাকে শাস্তিমূলক বদলি, পদোন্নতি আটকে কোণঠাসা করার নানা তৎপরতা। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি থেকে শুরু করে নানা সংকট লেগেই থাকে। অপারেশন থিয়েটারেও ভাগ করে কাজ করতে হয়। হাসপাতালের চাকরিতে যোগদানের পর থেকে চিকিৎসকদের ভাগ্যে আর বিশ্রাম জোটে না। ছুটির ক্ষেত্রেও তাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভুগতে হয়। একজন ডাক্তারের ছুটির আবেদন ৩৪টি বিভাগের টেবিল ঘুরে তবেই অনুমোদন পায়। এত সব মানসিক চাপের মধ্যেও চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ ধৈর্য নিয়ে রোগীদের সমস্যা শোনেন, দেখে সমাধান দিয়ে থাকেন। হাসপাতালের উপ-পরিচালক অধ্যাপক ডা. খাজা আবদুল গফুর বলেন, ‘আমাদের এখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসক রয়েছেন। আর প্রত্যেকেই রোটেশন (কর্মের সময়) অনুযায়ী নিজ নিজ কাজ করেন। রোটেশনের বাইরে কেউ অন্য কাজে থাকলে সেটা কর্তৃপক্ষ দেখবে না। রোটেশনের সময় কেউ কর্মে অনুপস্থিত থাকলে যথাযথ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

রাজশাহী মেডিকেলে তবিবুর-মহিবুল গ্রুপ : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক নেতাদের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। দুই গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন বিএমএ কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ডা. তবিবুর রহমান শেখ ও স্বাচিপ কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. মহিবুল হাসান। আর সুবিধা নিতে চিকিৎসকরাও বিভক্ত তবিবুর-মহিবুল গ্রুপে। পদ-পদবি, বদলি বাণিজ্য, ব্যক্তিগত রেষারেষি, নিজস্ব বলয় সৃষ্টি এ দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ। বিএমএর আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে এ দ্বন্দ্ব এখন চরমে। চিকিৎসকদের দলাদলিতে ভেঙে পড়েছে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা। চিকিৎসাসেবা নিয়ে রোগীদের অভিযোগের শেষ নেই। ফলে প্রায়ই ঘটছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, বিএমএ, স্বাপিচ ও মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের পদ একাই দখলে রেখেছেন ডা. খলিলুর রহমান। তিনি তবিবুর রহমান শেখের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া তবিবুর রহমান গ্রুপে রয়েছেন মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী, বিএমএ যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. শামীউল ইসলাম শিমুল। মূলত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ঠিকাদারি, কেনাকাটা, বদলি নিয়ন্ত্রণ এই গ্রুপের হাতে। জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলীর মদদে চলছে ঠিকাদারি সিন্ডিকেট। জনি নামের একজন চার বছর ধরে ঠিকাদারি কাজ পাচ্ছেন। ৯০ লাখ টাকার বই কেনাকাটায়ও অনিয়মের অভিযোগ আছে নওশাদ আলীর বিরুদ্ধে। তবে ডা. নওশাদ আলী বলেন, ‘জনি সরাসরি কোনো কাজ করে না। হয়তো অন্য কারও কাছ থেকে কিনে নেয়। আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে।’ আর ডা. তবিবুর রহমান শেখ বলেন, আমি কোনো গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করি না। তবে আমার কিছু ফলোয়ার আছে। তবে কোনো বিরোধ নেই।’

সিন্ডিকেটে জিম্মি রংপুর মেডিকেল : স্থানীয় ঠিকাদার ও চিকিৎসক সিন্ডিটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ সিন্ডিকেটকে অন্তরালে ইন্ধন জোগাচ্ছে বিএমএ, স্বাচিপ নেতা এবং স্থানীয় চিকিৎসকদের একটি গ্রুপ। বলা চলে রংপুর মেডিকেল কলেজ চলে এসব নেতার কথায়। হাসপাতালের কেনাকাটা থেকে শুরু করে ঠিকাদারি, বদলিও তাদের হাতেই।  রোগীদের অভিযোগ—বেলা ১২টার পরে কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না। জরুরি চিকিৎসার জন্য ডাক্তার পাওয়া যায় না। ডাক্তাররা ব্যস্ত ক্লিনিক নিয়ে। এমনকি কোনো রোগী ডাক্তারের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই তার চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া হয়।  অন্যদিকে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই নিজের খেয়ালখুশিমতো হাসপাতালে আসেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এমন অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গতকাল বেলা পৌনে ২টায় মেডিসিন বিভাগে গিয়ে কোনো চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। ব্যবস্থাপনা পরিষদের পরিষদের সদস্য আজমল হোসেন লেবু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাসপাতালে অরাজকতার পেছনে রয়েছে ঠিকাদার ও চিকিৎসকদের সিন্ডিকেট। এরা এতটাই প্রভাবশালী যে পুরো হাসপাতাল তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিএমএ রংপুর শাখার সভাপতি ডা. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে বিএমএ ও স্বাচিপের কোনো চিকিৎসক জড়িত আছে বলে মনে করি না।’

বরিশাল মেডিকেলে দলাদলিতে কোণঠাসা অভিজ্ঞরা : চিকিৎসকদের দলাদলিতে কোণঠাসা করা রাখা হচ্ছে অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের। এতে রোগীরা পড়ছেন ভোগান্তিতে। শিক্ষনবিশ চিকিৎসকরাও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেলের আধিপত্য এখন স্বাচিপ নেতাদের। তাদের কথায় চলে হাসপাতাল। মেডিকেল কলেজের বেশির ভাগ সিনিয়র চিকিৎসক ক্লাস ও হাসপাতালে রেখে প্রাইভেট চিকিৎসায় ব্যস্ত। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখে প্রতিদিন লাখ টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন তারা। এর ওপর তারা পাচ্ছেন বিভিন্ন প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ওষুধ কোম্পানির পার্সেন্টেজ। সবকিছু মিলিয়ে সারাক্ষণ টাকা কামানোর ধান্দা আর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তারা। বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের একজন মধ্যম সারির চিকিৎসক বলেন, ‘রুবেল স্যার অত্যন্ত উঁচু মানের একজন সার্জন। কিন্তু তাকে রাখা হয়েছে কোণঠাসা করে। কারণ তিনি বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাবের সঙ্গে জড়িত—এটাই তার অপরাধ।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম শরফুজ্জামান রুবেল বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। গত ৯ বছরে তিনি কোনো পদোন্নতি পাননি। অথচ তার জুনিয়র একজন চিকিৎসককে অধ্যক্ষ করা হয়েছে শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজে। নিয়মানুযায়ী অধ্যাপক না হলে তাকে মেডিকেলে কলেজের অধ্যক্ষ করার কথা নয়। কিন্তু স্বাচিপের প্রভাবে সহযোগী অধ্যাপক ডা. ভাস্কর সাহাকে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ করা হয় ২০১৫ সালে। অধ্যক্ষ পদে থাকাবস্থায় সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হয়েছেন ডা. ভাস্কর সাহা।

 

চট্টগ্রাম মেডিকেলে অনিয়মের ‘ঢাল’ বিএমএ! : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের চিকিৎসাসেবায় ভর করেছে  নানা অনিয়ম। তবে এসব অনিয়মে সবাই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন বিএমএ। বিএমএর নাম ব্যবহার করে একটি চক্র নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম করে চলেছে। অভিযোগ আছে, হাসপাতালের পূর্ব গেটের উত্তরে আছে অ্যাম্বুলেন্সের একটি বড় সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন ধরে একটি মহল এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। প্রতিটি গন্তব্যে পৌঁছতে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি ভাড়া দাবি করা হয়। এই চক্রটিও বিএমএর নাম ব্যবহার করে চলেছে বলে অভিযোগ আছে।  জানা যায়, হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে একটি দালাল চক্র। রোগীদের অভিযোগ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ রোগীর স্বজনদের দিয়ে কেনানো হয়। পরে এসব ওষুধ কিছু আয়া-ওয়ার্ডবয় ও দালাল হয়ে আবার ফার্মেসিতে বিক্রি করা হয়। 

অসুস্থ রাজনীতির কবলে ময়মনসিংহ মেডিকেল : অসুস্থ রাজনীতির কবলে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক)। চিকিৎসকদের অভিযোগ, স্বাচিপের কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব ডা. এম এ আজিজের ছোট ভাই জেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক এইচ এম ফারুক ওরফে টুপি ফারুকের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়ছেন তারা। বিনা কারণে চিকিৎসকদের বদলি, ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতির কারনে ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে সরকারের সেবামূলক বৃহৎ এ প্রতিষ্ঠানটি। সাধারণ চিকিৎসকরা বলছেন, এতে করে সুস্থ একটি মেডিকেলে এখন চলছে অসুস্থ রাজনীতির চর্চা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাচিপের কেন্দ ীয় মহাসচিবের বাড়ি ময়মনসিংহে হওয়ায় তিনি একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে চলছেন তার ছোট ভাইকে দিয়ে। এ প্রসঙ্গে গতকাল স্বাচিপের মহাসচিব ডা. আবদুল আজিজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার ভাই ময়মনসিংহে যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। সে স্থানীয় রাজনীতি করে বিধায় সবার সঙ্গেই সম্পর্ক রাখেন। বদলি বা চিকিৎসকদের ওপর খবরদারি করার কোনো প্রশ্নই আসে না।’

জনবল সংকট ওসমানী হাসপাতালে : সিলেট বিভাগের কোটি মানুষের উন্নত চিকিৎসার ভরসাস্থল ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। শুধু নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত নয়, জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য উচ্চবিত্তরাও সেবা নিতে ছুটে যান সরকারি এই হাসপাতালটিতে। দিন দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি জনবল ও অন্যান্য সুবিধা। জানা যায়, ১৯৯৮ সালে হাসপাতালটি ৫০০ শয্যা থেকে ৯০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু শয্যা বাড়ানো হলেও বাড়েনি জনবল। চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে ৫০০ শয্যার হাসপাতালে ১ হাজার ৫০৭ জন এবং ৯০০ শয্যার জন্য ২ হাজার ২৬৩ জনবল থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন ১ হাজার ৫৮ জন। হাসপাতালে শূন্য রয়েছে ১ হাজার ২০৫টি পদ। শূন্যপদ পূরণে বারবার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হলেও এখনো পদপূরণে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

* প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক শাহ দিদার আলম নবেল—সিলেট, মাহবুব মমতাজী—ঢাকা, কাজী শাহেদ—রাজশাহী, শাজহাদা মিয়া আজাদ—রংপুর, রাহাত খান—বরিশাল,  রেজা মোজাম্মেল—চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ থেকে সৈয়দ নোমান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর