সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

সরকারের ভিতরে ভ্যাট ষড়যন্ত্র

সব পণ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাটে বন্ধ হবে শিল্প কারখানা। বাড়বে বেকারত্ব। দাম বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর । নির্বাচনের আগে ব্যবসায়ী ও জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হবে ক্ষমতাসীনরা

রুহুল আমিন রাসেল

সরকারের ভিতরে ভ্যাট ষড়যন্ত্র

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সব পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়ের সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। নজিরবিহীন এ ভ্যাট আদায় করা হলে বিদ্যুৎসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। ভয়াবহ সংকটে পড়বে জনগণ। শিল্প-কারখানা বন্ধ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। ফলে বাড়বে বেকারত্ব। এ সিদ্ধান্তকে অনেকেই দেখছেন নির্বাচন ঘিরে দেশি-বিদেশি চক্রের ষড়যন্ত্রের মাস্টারপ্ল্যান হিসেবে। কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও অন্যান্য জিনিসের মূল্য বৃদ্ধিতে সরকারের প্রতি জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। উসকে উঠতে পারে সরকারবিরোধী মনোভাব। দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও ব্যবসায়িক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের নামে সবখানে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। এতে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। ভোগ্যপণ্যসহ সব জিনিসের দাম বাড়লে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়বে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ সংসদ নির্বাচনের ভোটেও দেখা যেতে পারে—এমন আশঙ্কাও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরাজ করছে বলে মনে করেন এফবিসিসিআই সভাপতি। জানা গেছে, বহুজাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘একটি শর্তযুক্ত ঋণ কর্মসূচি’র চাপে সরকার বাধ্য হয়ে তৈরি করে নতুন মূল্য সংযোজন কর—মূসক বা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাবিবর্জিত এ আইন তৈরি করার পর থেকে ব্যবসায়ীরা ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে আসছেন। তারা বলছেন, নতুন ভ্যাট আইন জনবিরোধী। এ আইনের দরকার নেই। প্রচলিত আইনে যে অসঙ্গতি আছে তা সংশোধন করাই শ্রেয়। অন্যদিকে এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের দেওয়া বেশকিছু সুপারিশ আমলে নিচ্ছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যদিও এনবিআর এবং ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌথ কমিটি এই সুপারিশমালা তৈরি করেছে। সরকার গঠিত এ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এনবিআরের সাবেক সদস্য আলী আহমাদ ও এফবিসিসিআইর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি জসিম উদ্দিন। ওই কমিটির ১০টি সুপারিশের একটিতে বলা হয়—নতুন আইনের ১৫(৩) ধারায় সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ একক হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো ভোক্তাপর্যায়ের ক্রেতা বা জনসাধারণ ১০০ টাকার যে পণ্য কিনবেন, তাতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট যুক্ত হবে। এ ধারায় আপত্তি জানিয়ে কমিটির সুপারিশে বলা হয়—উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণে অসমর্থ প্রতিষ্ঠানের করযোগ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপের বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট ও টার্নওভার কর প্রদানকারী উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণ করতে পারবেন না। এ সুপারিশের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়, সব করযোগ্য আমদানি ও সরবরাহের ক্ষেত্রে অভিন্ন হারে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেও একাধিক হ্রাসকৃত হারে এবং বহু স্তরে ভ্যাট হার বহাল আছে। বিদ্যুৎ বিতরণ, নির্মাণ সংস্থা সেবায় বর্তমানে ৫ ও ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য আছে। এ ছাড়া এমএস পণ্যসহ অন্য কতিপয় খাতে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপিত আছে। তাই বাংলাদেশের বাস্তব অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রেক্ষাপটে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাটের পরিবর্তে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানের সঙ্কুচিত ভিত্তিমূল্য ও ট্যারিফ মূল্যের বিকল্প হিসেবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে প্রচলিত ব্যবস্থার আলোকে এ সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ বাস্তবায়নে এনবিআরের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা ২৭ দফা বৈঠক করলেও তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি এনবিআর। বরং ব্যবসায়ীদের দাবি উপেক্ষা করে ১৮ এপ্রিল নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি পরিপত্র জারি করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান। পরিপত্রে বল হয়, নতুন আইনটি ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন করা হবে। এর ব্যত্যয়ের কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মাঠপর্যায়ের সব অফিসকে বিশেষভাবে সক্রিয় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ভ্যাট নিয়ে আন্দোলনরত ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও এফবিসিসিআই পরিচালক আবু মোতালেব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের গঠিত কমিটির সিদ্ধান্ত ও আমাদের দাবি বাস্তবায়ন না করে এনবিআরের পরিপত্র জারিতে ব্যবসায়ী সমাজ ক্ষুব্ধ। এ ক্ষোভের বড় ধরনের বহিঃপ্রকাশ যে কোনো সময় হতে পারে। সারা দেশের ব্যবসায়ীদের নিয়ে আমরাও ফের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ এদিকে সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে নজিরবিহীন ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যে নতুন আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা প্যাকেজ ভ্যাট বহাল রাখাসহ খুচরা ব্যবসা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতির সীমা বাড়ানোর দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছেন তারা। গত বছর বাজেট উপস্থাপনের আগে-পরে যেভাবে তারা আন্দোলন করেছিলেন, এবার এর চেয়েও ব্যাপক আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। ব্যবসায়ীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে, এবার এনবিআরের প্রাক-বাজেট সভাগুলোতেও। জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী এনবিআরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে। সে অনুযায়ী ২০১৪ সালে যৌথ কমিটি এবং গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর কোর ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। এ দুটি কমিটি কোনো বৈঠকেই বেশ কয়েকটি ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন করেনি এনবিআর। এমনকি ভ্যাট সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও আমলে নিচ্ছে না এনবিআর। বাংলাদেশ প্লাস্টিক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি শামীম আহমেদ বলেন, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করলে ১ হাজার ৩৭০টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে। এতে প্লাস্টিক খাতের ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। সম্পূরক শুল্ক উঠে গেলে প্লাস্টিক খাতের ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারবেন না। রি-রোলিং মিল অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, নতুন ভ্যাট আইনে ট্যারিফ পদ্ধতি থাকছে না। এ নিয়ে স্টিল শিল্প উদ্বিগ্ন। তাই শিল্পের স্বার্থে ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন হিসাব করা উচিত। এর ব্যত্যয় ঘটলে লৌহ শিল্পে ধস নামবে। আয়রন অ্যান্ড স্টিল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি আমির হোসেন নুরানী বলেন, এক টন মালামাল বিক্রি করলে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা মুনাফা হয়। কিন্তু ৪ শতাংশ হারে ট্রেড ভ্যাট ধরলে ১৫ হাজার টাকা ভ্যাট দিতে হয়, যা ব্যবসায়ীদের ওপর জুলুম ছাড়া কিছুই নয়।

সর্বশেষ খবর