সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

পূর্বাচলে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জমি দখল করে মার্কেট

দেখার কেউ নেই

সাঈদুর রহমান রিমন

পূর্বাচলে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জমি দখল করে মার্কেট

পূর্বাচলে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সরকারের পরিকল্পনা ছিল ক্রিকেট স্টেডিয়াম হবে পূর্বাচলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবৈধ দখলবাজির কাছে ভেস্তে যেতে বসেছে ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রকল্প। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—  রাজউক পূর্বাচল আবাসনে স্টেডিয়ামের জন্য বরাদ্দকৃত জমি ‘আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে দখল করে নিয়েছেন রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌসি আলম নীলা। ফলে উপশহরে বৃহত্তম স্টেডিয়াম গড়ে তোলার উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। জায়গাটি জবরদখল করে গড়ে তোলা হয়েছে শতাধিক দোকানপাটের ‘নীলা মার্কেট’। মার্কেটটি জমিয়ে তুলতে প্রতি রাতেই বসছে অশ্লীল নৃত্য, জুয়া ও মাদকের আসর।

জানা গেছে, পূর্বাচল উপশহর গড়ে ওঠার লক্ষ্যে ভোলানাথপুরসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সুদৃশ্য রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে খোলামেলা ঘুরে বেড়াতেও ভালো লাগে। সড়কের আশপাশের এলাকাগুলো অতিনির্জন। এজন্য বিভিন্ন স্থান থেকেই মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন। তাদের টার্গেট করেই নীলা মার্কেট ও আশপাশ এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে মাদকের আস্তানা। বসানো হয়েছে হরেক রকম জুয়ার আসর এবং নারীকেন্দ্রিক নানারকম অপরাধ আখড়াও। র‌্যাব, পুলিশসহ প্রশাসনের চোখের সামনে জবরদখলসহ অবৈধ কর্মকাণ্ড চললেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে রাজউকের বিরুদ্ধেও। তারা স্টেডিয়াম হিসেবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে জায়গাটি বরাদ্দ দিলেও তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনো বুঝিয়ে দেয়নি। ফলে ওই জায়গায় পাকা-আধাপাকা দোকানপাট বানিয়ে নির্বিঘ্নে জবরদখল পাকাপোক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তবে রাজউক সূত্র বলেছে, আগেও অবৈধভাবে গড়ে তোলা নীলা মার্কেটটি একবার উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আবারও সেখানে দোকানপাট খোলা হয়েছে। এর পরও একাধিকবার উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েও পুলিশের সহায়তার অভাবে অভিযান চালানো যায়নি। রাজউক চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘খুব শিগগির উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করে জায়গাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।’ স্থানীয় বাসিন্দারা বলেছেন, মোটা অঙ্কের টাকায় পজিশন কিনে পাকা-আধাপাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। মাসিক ভাড়ার ভিত্তিতে চালানো হচ্ছে দোকানপাট। তাদের নোটিস দিয়ে, মাইকিং করে কিংবা বুলডোজার দিয়ে সহজে উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে না। সেখানে ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে নতুন জটিলতা বাধানোর চেষ্টা চলবে। ‘নীলা মার্কেট’-এর অনুমোদন চেয়ে রাজউক বরাবর একটি আবেদনপত্র দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। কিন্তু রাজউক অনুমোদন দেয়নি। এরই মধ্যে জায়গাটিতে অবৈধ মার্কেট গড়ে তোলাসহ দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার বাণিজ্য করে ভাইস চেয়ারম্যান নীলা মাসে ১০ লক্ষাধিক টাকা আদায় করছেন। সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে নীলা মার্কেটে পাকা-আধাপাকা কয়েক শতাধিক দোকানঘর। এসব দোকানঘর থেকে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন বিদ্যুৎ, পানি ও পরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে প্রতি দোকান থেকে আকারভেদে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে নীলাবাহিনী। মার্কেট ঘিরে ভোলানাথপুরসহ আশপাশ এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদকের আস্তানা। এসব আস্তানায় অতি সহজেই পাওয়া যাচ্ছে মরণনেশা বিভিন্ন প্রকার মাদক। শুধু তাই নয়, নীলা মার্কেটের আশপাশ নির্জন জায়গা বিধায় সেখানে প্রতিদিন শত শত যুবক-যুবতী ঘুরতে এসে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। নীলা মার্কেটের সামনেই রয়েছে একটি কবরস্থান। এর ভিতরেই মাদকের মজুদ গড়ে তুলে খুচরাভাবে হরদম কেনাবেচা চালানো হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন ও রাজউকের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই রাজউকের জমিতে জবরদখল করে নীলা মার্কেট করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি দোকানঘরের পজিশন বিক্রি করা হয়েছে। একেকটি পজিশনের মূল্য ১ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। এসব টাকা আদায় করেন ভাইস চেয়ারম্যান নীলার স্বামী ফটিক মিয়া। প্রতিদিন রাজধানীসহ আশপাশ এলাকার লোকজন এ মার্কেটে ভিড় জমাচ্ছে। বিশেষ ধরনের কয়েকটি রেস্টুরেন্টে যুবক-যুবতীদের অসামাজিক কর্মকাণ্ড করার জন্য আলাদা কক্ষ রয়েছে। ঘণ্টায় ১ থেকে ২ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। জুয়ার আসরে প্রতি রাতে লাখ লাখ টাকার খেলা হচ্ছে। জুয়া খেলতে বেশির ভাগ লোকই আসে রাজধানী থেকে। এ ছাড়া স্থানীয় লোকজনও জুয়া খেলায় অংশ নেয়। মাদক ও জুয়ার স্পট থেকেও আদায় হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। পূর্বাচল ১ নম্বর সেক্টর থেকে দক্ষিণে বালু নদের তীর পর্যন্ত সারি সারি খুপরি ঘর তুলে চাইনিজ রেস্টুরেন্টের নামে চলে মাদক সেবন, পতিতাবৃত্তিসহ নানারকম বেলেল্লাপনা। এ ছাড়া নীলা মার্কেটে সব ধরনের মাদকের রমরমা বাণিজ্য পরিচালনা করেন নীলার দেবর আনোয়ার হোসেন; যার নিয়ন্ত্রণে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি গ্রুপ মাদক বিক্রি ছাড়াও খদ্দেরদের তা নিরাপদে সেবনের জায়গারও ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রূপগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, নীলা মার্কেটটি দলীয় সাইনবোর্ডে দখল হলেও আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীর সেখানে যাতায়াত অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। নীলা মার্কেট ও সংলগ্ন এলাকার যাবতীয় অপরাধ-অপকর্মের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে রয়েছেন সালাউদ্দিন, বাকির, রাসেল, নুরুজ্জামান, রাকিব, মোমেন, বাসিত, আবুসহ ১০-১২ জন। তারা সবাই নীলা নেত্রীর চিহ্নিত ক্যাডার বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী। ভুক্তভোগীরা জানান, অবৈধভাবে নীলা মার্কেট গড়ে তোলাসহ অপরাধ-অপকর্মের বিরুদ্ধে কারও টুঁশব্দটি করারও জো নেই। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদকারীকে সমুচিত শাস্তি দিতে হাজির হয়ে যায় নীলার ক্যাডাররা। এক প্রশ্নের জবাবে ফেরদৌসি আলম নীলা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘বাজারকে কেন্দ্র করে মেলার নামে জুয়া, নগ্ন নৃত্য, মাদক বাণিজ্য ঘটে থাকলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে।’ রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বলেন, ‘জায়গা জবরদখলের বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজউক দেখবে। রাজউক যদি উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেয় তাহলে আমরা সহযোগিতা করব।’ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে জমিটি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দিয়েছি। এটা এখন তাদের সম্পত্তি। তারা স্টেডিয়াম করার জন্য দরপত্র আহ্বানসহ যা যা করার সেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে। তার পরও তারা আমাদের কোনো সহযোগিতা চাইলে অবশ্যই করব।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান এম বজলুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘স্টেডিয়ামের জমি অবৈধ দখল হলে অবশ্যই উচ্ছেদ করা হবে। আগেও অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। শিগগিরই আবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। অবৈধ উচ্ছেদ অভিযান চলমান প্রক্রিয়া।’

স্টেডিয়ামের জমি অবৈধ দখলের পেছনে রাজউকের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে— এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পেলে বা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর