বুধবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

ষড়যন্ত্র সরকারের ভিতরে বাইরে

অভ্যন্তরীণ বিরোধ বাড়ছে দলে। প্রভাবশালীদের কারণে ব্যবসায়ী, মিডিয়া ও পেশাজীবীদের সঙ্গে দূরত্ব। নানামুখী অপতৎপরতায় অস্বস্তি। উন্নয়ন প্রকল্প গতিহীন। অনেক আমলা ব্যস্ত সুবিধা নিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক

নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসছে ততই বাড়ছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধ। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের ভূমিকা, তৎপরতা, আদেশ, নির্দেশে ব্যবসায়ী, পেশাজীবীসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব সরাসরি বাড়িয়ে তুলছে। অসন্তোষের অনল তৈরি করছে ঘাটে ঘাটে। গতানুগতিক দেখা যায়, নির্বাচন এলে বিভিন্ন সমস্যা দূর করে সব মহলের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা চলে। কিন্তু হঠাৎ করে সবই হচ্ছে তার বিপরীত। প্রভাবশালীদের কাজকর্মে অসঙ্গতি। ক্ষমতা জাহিরকরণ ও হয়রানি এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করছে। অগ্রাধিকার পাওয়া উন্নয়ন প্রকল্পে গতি নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বর্তমানে স্বাভাবিক অবস্থা দৃশ্যমান, বাস্তব চিত্র ভিন্ন। জাতীয় নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, সরকারের অভ্যন্তর থেকে নানারকম জটিলতা ততই বাড়ছে। সরকারকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে নানামুখী তত্পরতা চলছে সরকারের ভিতর-বাইরে; যার ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ভিতরে-ভিতরে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। দেশের মিডিয়া, প্রশাসন, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী গ্রুপসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বাড়ছে দূরত্ব। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন। কিছু কিছু উন্নয়ন প্রকল্প দৃশ্যমান হলেও নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় জনদুর্ভোগ বাড়ছে। এসব উন্নয়নকাজে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কোনো নজর নেই। বরং সরকারঘনিষ্ঠ আমলারা নিজেদের সুবিধা নিতেই ব্যস্ত। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে শুরু করে একেবারে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত আমলারা নিজেদের আখের গোছানোয় ব্যস্ত। অনেকের হিরোইজমে হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার লোকজন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকারের ভিতরে-বাইরে যে তত্পরতা চলছে, এখনই পদক্ষেপ না নিলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এর চরম মূল্য দিতে হবে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন প্রভাবশালী মহাপরিচালক (ডিজি) প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত। ওই ডিজি সম্প্রতি প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে ঘোরাঘুরি করে হৈ চৈ করেছেন রাজধানীর একটি এলাকায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই ডিজির বিরুদ্ধে আরও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজের স্বার্থে জামায়াত ও বিএনপি সমর্থিত কর্মকর্তাদের নিজের ছায়াতলে রাখতে দ্বিধা করেন না। কারণ তাদের দিয়ে সব অপকর্ম করান। এসব অভিযোগের বিষয়ে তার ব্যাচমেটরাও জানেন। কিন্তু প্রভাবশালী কর্মকর্তা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেন না। শুধু এই কর্মকর্তাই নন, সিভিল প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই এখন ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছাতে। এরা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে প্রভাব খাটিয়ে দফায় দফায় পদোন্নতি নিয়েছেন অথচ সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিবর্তে তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। এই কর্মকর্তারাই সুযোগ পেলেই ভিতরে-বাইরে সরকারের সমালোচনা করছেন। এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে উসকে দিচ্ছেন। আবার অনেক বড় কর্মকর্তার নিজ বাড়ির লোকজনই সরাসরি বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অথচ তারা এখন দাপুটে পদে রয়েছেন। সরকারের সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেকেই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। ঘাটে ঘাটে তাদের নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সিভিল প্রশাসনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। মাঠ পর্যায়ে ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, শিক্ষা অফিসসহ জনসম্পৃক্ত অফিসগুলোয় প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এগুলো মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে তুলছে। এতসব সমস্যার মধ্যে এখন নতুন করে আরেক সমস্যা হচ্ছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বৃদ্ধি করার তত্পরতা। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন বাস্তবায়নের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। হঠাৎ করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়ের এই প্রস্তাব নিয়ে দেশের সর্বস্তরের ব্যবসায়ীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটি বাস্তবায়ন হলে ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠবে। একই সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়ের প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন হলে সাধারণ মানুষকেও এর মূল্য দিতে হবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মূলত সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব বাড়াতে এবং সরকারের বিরুদ্ধে তাদের খেপিয়ে তুলতেই এমন প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দেশের মিডিয়াগুলোর সঙ্গেও দূরত্ব বাড়ছে সরকারের। পুলিশ ও জনপ্রশাসনের পাশাপাশি এনবিআর এবং দুদকের কিছু কিছু তত্পরতাও সরকারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন গ্রুপের। যাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। সেবা খাতগুলোয় সমন্বয়হীনতা আর অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে মানুষকে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড, ওয়াসা, বিদ্যুৎ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—রাজউক, গ্যাসসহ সব খাতেই প্রতিনিয়ত ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কোনো সমন্বয় নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সরকারের ভিতরে-বাইরে শুধু সিভিল প্রশাসন বা পুলিশ প্রশাসনের লোকজনই সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তত্পর এমন নয়; তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতও। মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত এই অন্তর্দ্বন্দ্ব। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের একটি অনুষ্ঠান ঘিরে ঘটে যাওয়া সহিংসতা। রবিবার মন্ত্রী সেখানে একটি সরকারি ভবন উদ্বোধন করতে গেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ অবস্থা শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ই নয়, পুরো দেশের মাঠ পর্যায়ে শাসক দল আওয়ামী লীগের একাধিক গ্রুপ কলহ-কোন্দলে ব্যস্ত। মন্ত্রী-এমপিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব গ্রুপ দলকে সংগঠিত করার চেয়ে বেশি তত্পর নিজেদের উন্নয়নে। কোথায় কোন উন্নয়নকাজ হচ্ছে, তা কীভাবে বাগিয়ে নেওয়া যায় সেটাই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এই গ্রুপিং রাজনীতি আরও প্রবল হয়ে উঠছে। আর সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে। সরকারের ভিতর-বাইরের নানা তত্পরতার কারণে সরকার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি সরকারের মোটা দাগের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো ঠিকমতো চলছে না। শুধু যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব আর সমন্বয়হীনতা সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে যেসব বিষয় এবং প্রকল্পকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সেগুলোই এখনো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিতে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। আর ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়েও এ প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হচ্ছে না। সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছিল ১০০ ইকোনমিক জোন করার ওপর। এর মধ্যে ৫৬টির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কাজ হচ্ছে হাতে গোনা কয়েকটির। বাকিগুলো এখনো কাগজপত্রে। সব মিলিয়ে সরকার এখন নানারকম জটিলতার মধ্যে রয়েছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, দ্রুততার সঙ্গে এখনই এ সমস্যার প্রতিকার না করলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতে পারে।

সর্বশেষ খবর