শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

বড় হলে নিশ্চয়ই হাড়বজ্জাত হবে

সমরেশ মজুমদার

বড় হলে নিশ্চয়ই হাড়বজ্জাত হবে

বাল্যকালে কোনো অন্যায় করলে বাবা যখন খুব রেগে যেতেন তখন ঠাকুরদা তাকে বলতেন, ‘এখনো ছেলেমানুষ, না বুঝে করছে, বড় হলে ঠিক পাল্টে যাবে।’ বড় পিসিমা বলতেন, ‘ছেলেবেলায় যে ছেলে খুব শান্তশিষ্ট থাকে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। বড় হলে নিশ্চয়ই হাড়বজ্জাত হবে।’ অর্থাৎ প্রচলিত ধারণা ছিল, বাল্যকালের স্বভাব বড় হলে বদলে যায়। এই বদলে যাওয়া ব্যাপারটা নাকি অজান্তেই ঘটে যায়। জলপাইগুড়ি শহরে আমাদের কিশোরকালে প্রায়ই মারপিট হতো। প্রায় প্রতিটি পাড়ায় কিশোর-তরুণদের একটা দল থাকত। বছরে কয়েকবার এই পাড়ার সঙ্গে ওই পাড়ার সংঘর্ষ হতো। তখন কিছু দিন পাড়া ছেড়ে বের হওয়া যেত না। মারপিটের কয়েকটা নির্দিষ্ট কারণ থাকত। এক. অন্য পাড়ার কোনো ছেলে পরপর তিন দিন এপাড়ায় এসে সাইকেলের বেল বিশেষ মেয়ের উদ্দেশে বাজালে তাকে একটু-আধটু চাঁটা মেরে ছেড়ে দেওয়া হতো। সে নিজের পাড়ায় ফিরে গিয়ে জানালে সংঘর্ষ অনিবার্য হতো। দুই. দুর্গাপুজোর ভাসান হতো করলা নদীতে। কে কত জাঁকজমক দেখাতে পারে তার প্রতিযোগিতা হতো। তারপর নৌকায় প্রতিমা চাপিয়ে নদীতে ঘোরার সময় ওপাড়ার নৌকো যদি এপাড়ার নৌকোকে স্পর্শ করত তা হলে আর দেখতে হতো না। পরের সকালে যুদ্ধ না করলে সম্মান থাকত না। তিন. ফুটবল খেলায় প্রতিপক্ষ যদি বেশি ফাউল করত তা হলে খেলা ভণ্ডুল করে ফিরে যেত যে যার পাড়ায়। তারপর অস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি।

সেসব মহাযুদ্ধের অস্ত্র কীরকম ছিল? প্রায়ই প্রত্যেকে হাতে হকিস্টিক রাখত। না থাকলে লাঠি। তখনো পাইপগান বা বোমার চল শুরু হয়নি। মারপিটের আঁচ পাওয়ামাত্র রাস্তার দুই পাশের সমস্ত পানের দোকান ঝাঁপ বন্ধ করত। কারণ সেই দোকানের সোডার বোতল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। মার্বেলওয়ালা কাচের সোডার বোতল ছুড়ে মারার একটা কায়দা থাকত যার জন্য বোতলটা মাটিতে পড়ামাত্র বিকট শব্দে ফেটে যেত। আমাদের পাড়ার শুভঙ্কর ওই ব্যাপারে এক্সপার্ট ছিল। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম কবে কার কাছে কখন শুভঙ্কর কায়দাটা শিখল। ওকে জিজ্ঞাসা করলে কাঁধ নাচাত, মুখে কিছু বলত না।

মারপিটে কারও মাথা ফেটে যেত, কারও শরীরে কাচ ঢুকলেও কেউ মারা যেত না। তারপর বহু দূরে একটা পুলিশের জিপ দেখলেই দুই দল-ই হাওয়া হয়ে যেত। আহতদের তাদের বাবা-কাকারা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে কী অজুহাত দিতেন তা জানি না কিন্তু কারও বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করা দূরের কথা, অ্যারেস্টও করত না। জলপাইগুড়িতে তখন তিনটে সিনেমা হল ছিল। উত্তম কুমারের ছবি এলেই টিকিট ব্ল্যাক হতো। এ নিয়েও মারপিট কম হতো না। বিশেষ করে সোয়া পাঁচ আনার টিকিটের জন্য। তারপর বিভিন্ন পাড়ার মারপিটের নেতারা একসঙ্গে বসে ঠিক করলেন সপ্তাহের সোম থেকে শনিবারের ম্যাটিনি এবং ইভনিং শো কোন কোন পাড়ার জন্য বরাদ্দ হবে। তাই চলেছিল কয়েক মাস। শুভঙ্করকে মারপিট করার অভিযোগে স্কুল থেকে দুবার বের করে দিতে চেয়েছিলেন হেডমাস্টার মশাই। ওর দাদু গিয়ে অনেক অনুরোধ করায় ক্ষমা পেয়েছিল সে। তবে তৃতীয়বার সে অপরাধ করলে আর ক্ষমা করা হবে না বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। শুভঙ্কর সেটা না করে শতকরা আটান্ন নম্বর পেয়ে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় পাস করেছিল। তারপর তার দাদু তাকে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন কলেজে পড়ার জন্য, আমিও কলকাতায় চলে আসি। বহু বছর তার সঙ্গে দেখা হয়নি।

বেশ কয়েক বছর আগে দিল্লিতে গিয়েছিলাম। মান্ডি হাউসে গিয়েছিলাম কাজের সূত্রে। কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসছি, দেখলাম শুভঙ্কর ঢুকছে। প্রায় তিরিশ বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও মনে হলো আমি ঠিক ভাবছি। লম্বা, স্বাস্থ্যবান, স্যুট-টাই এবং দামি চশমা পরা লোকটি আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল যখন, তখন নামটা উচ্চারণ করলাম।

সঙ্গে সঙ্গে সে দাঁড়িয়ে গেল, আমার দিকে তাকাল এবং স্পষ্ট ইংরেজি উচ্চারণে বলল, ‘আপনার পরিচয়টা দিলে সুবিধে হয়।’

নিজের নাম এবং শহরের কথা বলতেই, সে বলল, ‘বাঃ, কেমন আছ? দিল্লিতেই?’

‘না। কলকাতায়। কাজে এসেছি এখানে।’

‘হাতে সময় নেই সমরেশ, এই কার্ডটা রাখো, যদি সন্ধের পর সময় পাও তা হলে ফোন করলে কথা হতে পারে।’ নিজের কার্ড আমার হাতে দিয়ে সে গম্ভীরভাবে হেঁটে গেল।

কার্ডে ওর পরিচয় পাওয়া গেল। শুভঙ্কর এখন আইএএস। ভারত সরকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ দফতরের সেক্রেটারি। ঠিকানা এবং তিনটি ফোন নম্বর দেওয়া আছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মন চলে গেল কিশোরবেলায়। যে পানওয়ালা তখনো দোকান বন্ধ করতে পারেনি তাকে ধমকে শুভঙ্কর দুটো সোডার বোতল তুলে নিচ্ছে। বোতলের মুখে আঙুল চেপে দ্রুত বাঁকিয়ে নিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে ছুড়ছে। সেই শুভঙ্কর আর এই শুভঙ্কর কি এক মানুষ? দাদু পিসিমার কথা ওর ক্ষেত্রে মিলে গেল। বড় হলে বদলে যাবে।

সন্ধের পর শুভঙ্করকে ফোন করলে সে গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে গেল। বিশাল ফ্ল্যাট, চমৎকার সাজানো। কাজের লোক আমাকে বসতে বলার মিনিট দুয়েক পরে সে এলো ধোপভাঙা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে। আমরা কথা বললাম। লক্ষ্য করলাম সে বলার চেয়ে শোনাই বেশি পছন্দ করছে। মাঝে মাঝে, আচ্ছা, আই সি, রাইট শব্দ ব্যবহার করছে। ওর চারপাশে গাম্ভীর্যের বাতাবরণ, যা বেশ চেষ্টায় তৈরি করেছে। একটু পরেই কাজের লোক চা-প্যাটিস নিয়ে এলো ট্রলিতে চাপিয়ে। সঙ্গে ওর স্ত্রী। শুভঙ্কর বলল, ‘আমার স্ত্রী সোহিনী, পাঞ্জাবের মেয়ে। বাংলা বলতে পারে না।’

সোহিনী ইংরেজিতে বললেন, ‘আজই আপনার কথা প্রথম শুনলাম। চা নিন।’

শুভঙ্কর বলল, ‘সোহিনীর স্টকে গোটা আটেক রবীন্দ্রসংগীত আছে।’

রবীন্দ্রসংগীত শব্দটি কানে যেতে সোহিনী অনুমান করে হাত নাড়লেন, বোঝালেন, ওই প্রসঙ্গ থাক। দেখলাম, আমরা কথা খুঁজে পাচ্ছি না। এই সময় একটি তরুণ বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে। রোগা, ফরসা, পরনে বিবর্ণ জিন্স, গেঞ্জি, কানে দুল, চুল লম্বা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাই।’

বললাম, ‘হ্যালো!’

সে কাঁধ ঝাঁকাল। ঠিক যেভাবে শুভঙ্কর কিশোরবেলায় কাঁধ নাচাত। তারপর মায়ের দিকে হাত বাড়াল, আঙ্গুল নেড়ে ইশারা করল।

শুভঙ্করের স্ত্রী বললেন, ‘সরি মিত।’

‘ডোন্ট সে সরি। আই নিড টু অ্যান্ড হাফ।’ গলা তুলল ছেলে।

শুভঙ্করের স্ত্রী বিরক্ত হয়ে ভিতরে চলে গেলে ছেলে তাকে অনুসরণ করল। তারপরই ছেলের চিৎকার এবং মায়ের চাপা গলা শোনা গেল। মহিলা বোধহয় আমার কথা বললেন। ছেলে বলল, ‘হু ইজ হি? আই ডোন্ট কেয়ার।’

শুভঙ্কর বলল, ‘আজকালকার ছেলেরা একটু জেদি হয়।’ হাসল সে, ‘দিল্লিতে কিছুদিন আছ তো। আমার আবার কালই বাইরে যাওয়ার কথা।’

বাইরে বেরিয়ে আমরা দুজনেই স্বস্তি পেয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত, দাদু পিসিমার ভবিষ্যদ্বাণী এই ছেলেটির ক্ষেত্রে খাটবে না। শুভঙ্কর নিজেকে পাল্টেছে, ছেলেকে পাল্টানোর স্বপ্ন দেখায়নি।

সর্বশেষ খবর