শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
মুখ খুললেন কাসেম বিন আবুবাকার

পকেটে আছে ১০ টাকা, বেশি কীভাবে খরচ করব

পশ্চিমা মিডিয়া, কাসেম ও ইসলামী ফিকশন

আলী রীয়াজ

পকেটে আছে ১০ টাকা, বেশি কীভাবে খরচ করব

হঠাৎ তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে লেখক কাসেম বিন আবুবাকারকে নিয়ে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে সাক্ষাৎকারে তিনি জানালেন, খোলামেলা নানা কথা। বললেন, ইসলামী উপন্যাস লিখিনি। পকেটে আমার ১০ টাকা এর বেশি কীভাবে খরচ করি।

বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা সক্রিয় তাদের এক বড় অংশ শেষ পর্যন্ত ঔপন্যাসিক কাসেম বিন আবুবাকারকে ‘আবিষ্কার’ করতে সক্ষম হয়েছেন; সে জন্য তারা অবশ্যই পশ্চিমা গণমাধ্যমের, বিশেষত ব্রিটেনের ডেইলি মেইলের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন, অবশ্যই এএফপির কাছেও। কিন্তু আবিষ্কারের পর তাদের আলোচনা থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, এই লেখকের বিষয়ে তারা কিছু না জানায় বিস্মিত এবং খানিকটা ক্ষুব্ধ। অনেকের সমালোচনার ভঙ্গি আক্রমণাত্মক, অনেকের ভঙ্গি সমর্থনসূচক। যারা প্রথম ধারায় শামিল তাদের কারণের তালিকা দীর্ঘ। তাদের কেউ কেউ এমন ধারণা দিচ্ছেন যে, তাদের না জানাই প্রমাণ করে এগুলোর কোনো গুরুত্ব নেই। বিপরীতক্রমে দ্বিতীয় ধারায় যারা শামিল হয়েছেন তাদের কথার মূল সুর হচ্ছে— এই ধরনের উপন্যাস হচ্ছে এ দেশের ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের’ কাছে প্রিয়। অতএব সেটিই তাদের জীবনধারার প্রতিফলন। অতিরঞ্জনের বিষয় বাদ দিলাম, কেননা সেগুলো আলোচনার দাবি করে না। উপন্যাসের (বা কবিতা/গল্পের) সাহিত্য মূল্য কেবল জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে বিচার্য নয়; রাজনীতিতে যারা মেজরিটারিয়ানইজমের সমর্থক তারাই কেবল জনপ্রিয়তা দিয়ে সাহিত্য মূল্য বিবেচনা করতে পারেন। এই সাহিত্য দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনের প্রতিনিধিত্ব করার দাবির মধ্যে এই বক্তব্যই লুকানো যে, সাহিত্যে ‘অনেক মানুষের’ জীবনের প্রতিফলন ঘটাতেই হবে। একইভাবে কোনটা সাহিত্য আর কোনটা সাহিত্য নয়, সে বিষয়ে ব্যক্তিগত মত প্রকাশের অধিকার সবার আছে, কিন্তু চূড়ান্ত কথা বলার কোনো অবকাশ নেই। কাসেম বিন আবুবাকারের উপন্যাস এবং তার জনপ্রিয়তার বিষয়টি বাংলাদেশের জনপরিসর বা পাবলিক স্ফেয়ারের চরিত্র, প্রকৃতি এবং তার পরিবর্তনের যে চিত্র তার মধ্যে স্থাপন করে দেখতে হবে।

যারা জনপরিসর নিয়ে গবেষণা করেন তাদের এসব বিষয়ের দিকে নজর রাখা আবশ্যক, দেখা দরকার যে কোন সমাজের জনপরিসরে কোন ধরনের প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে এযাবৎ জনপরিমণ্ডল ব্যবস্থার ধারণার ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ যৌক্তিকতা বা ধর্মীয় উদারনৈতিকতা। কিন্তু গত কয়েক দশকে একটি ইসলামী বা ইসলামপন্থি জনপরিমণ্ডল ব্যবস্থা তৈরির প্রক্রিয়া বাংলাদেশে ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এর একটি প্রকাশ হচ্ছে ইসলামী ফিকশন (এর আরও অনেক ধরনের উদাহরণ রয়েছে)। কাসেম বিন আবুবাকার সেই ধারা এবং বাংলাদেশের জনপরিসরে ইসলামিক সেন্সিবিলিটির বিকাশের সঙ্গে যুক্ত। এই ধরনের উপন্যাস জনপরিমণ্ডলের ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এ বিষয়ে মনোনিবেশ করা দরকার কাউকে নিন্দা করার (ভিলিফাই অর্থে) জন্য নয়, বরং জনপরিসরের মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো ঘটছে তা বোঝার জন্য। সেই জন্য দরকার উন্মুক্ত আলোচনার পরিবেশ; সেটা গণমাধ্যমের আলোকচ্ছটা (বা গ্লেয়ারের) মধ্যে বসে করার চেয়েও দরকার গবেষণার মাধ্যমে, সহনশীলভাবে। বাংলাদেশের জনপরিসরের এই নতুন দিক যেহেতু ইসলামপন্থিদের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সেহেতু যারা নিজেদের সেক্যুলারপন্থি মনে করেন বা দাবি করেন তারা এর বিরোধী। সবাইকে এর সঙ্গে একমত হতে হবে সেটা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু এটা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, এই বিরোধিতার সঙ্গে যুক্ত আছে সেক্যুলারিজম সম্পর্কে তাদের ধারণা। সেক্যুলারিজমের ধারণার বিষয়কে এড়িয়ে গিয়ে কিংবা সেই বিষয়ে আলোচনার দরজা-জানালা বন্ধ করে জনপরিসরের এ বিষয়গুলো আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকবে, সম্ভবত ভুলও হবে। প্রশ্ন হচ্ছে এই আলোচনা করতে আমাদের প্রস্তুতি আছে কিনা।

জনপরিসরের এই পরিবর্তনের আলোচনা বিষয়ে অনেকে নজর না দিলেও এবং হঠাৎ করে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে মনে করলেও বাস্তব হচ্ছে এসব বিষয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা চলছে। সেটা কেবল পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর বিষয়ে হচ্ছে তাই নয়, বাংলাদেশের বিষয়েও হচ্ছে। যেমন ধরুন ইসলামী/ইসলামপন্থি ফিকশন। এ বিষয়ে ২০০৩ সাল থেকেই আলোচনা হচ্ছে (দেখুন মায়মুনা হকের আলোচনা ‘From Piety to Romance : Islam-Oriented Texts in Bangladesh’, in New Media in the Muslim World : The Emerging Public Sphere, ed. Dale Eickelman, J.W. Anderson and Mark Tessler; Bloomington : Indiana University Press, ২০০৩; এ বিষয়ে ২০০৯ বোস্টনের টাফট ইউনিভার্সিটি এবং ২০১০ সালে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত দুটি সম্মেলনে উপস্থাপিত আমার একটি রচনায় আমি আলোচনা করি যার বিভিন্ন ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে। আমার লেখা ২০১৩ সালে Global Change, Peace & Security, [Vol 25, No 3] জার্নালে প্রকাশিত হয় এবং ২০১৫ সালে প্রথমা থেকে প্রকাশিত How Did We Arrive Here? বইয়ে তার একটা ভাষ্য আছে; বাংলা অনুবাদ আছে প্রতিচিন্তার দশম সংখ্যায় ‘বাংলাদেশে নতুন ইসলামপন্থি জনপরিমণ্ডল’)। এই আলোচনাগুলো কিন্তু একেবারে বিচ্ছিন্ন কাজ নয়, বাংলাদেশে ইসলাম এবং পাবলিক স্ফেয়ারে ইসলামের বিভিন্ন ধরনের প্রকাশের বিষয়ে সামিয়া হক, সেউতি সবুর, সাবিনা ফায়েজ রাশিদ, দীনা সিদ্দিকী (এবং আরও অনেকেই) কাজ করেছেন; তাদের কাজের সঙ্গে পরিচয় থাকলে আমরা সম্ভবত এই ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গেও পরিচিত থাকতাম এবং এএফপির সূত্রে ঘরের দরজায় প্রকাশিত বইয়ের খবর পেতে হতো না।

মনে রাখা দরকার যে, ইসলামী ফিকশন/থ্রিলারই পাবলিক স্ফেয়ারের একমাত্র দিক নয়; আরও অনেক দিক আছে যেগুলোর দিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার বোঝার জন্য কেন এবং কীভাবে এই বিকল্প জনপরিমণ্ডল গড়ে উঠছে। আবার বলি, সেক্যুলারিজমের প্রচলিত ধারণাকে ‘ফেইথ’ বা বিশ্বাস হিসেবে নিয়ে এগোলে এই আলোচনা করা দুরূহ হবে। ফলে বড় ছবিটা বিবেচনায় নিয়ে আলোচনার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা দরকার।

সর্বশেষ খবর