সোমবার, ১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

সংকুচিত হচ্ছে শ্রমবাজার

♦ বন্ধ আমিরাতের দরজা
♦ শর্তের জালে সৌদি আরব
♦ কারসাজিতে মালয়েশিয়া
♦ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক-লিবিয়া
♦ সংকট রোমানিয়া, গ্রিস, ইতালিসহ ইউরোপেও

জুলকার নাইন

সংকুচিত হচ্ছে শ্রমবাজার

নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যে কেনো মুহুর্তে হতে পারে দুর্ঘটনা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই কাজ করেন শ্রমিকরা। রাজধানীর ইস্কাটনে ১২তলা ভবনের ১১তলায় গতকাল দুই শ্রমিকের কর্মব্যস্ততা — রোহেত রাজীব

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। সেখানে ২০০৭ সালে কর্মী পাঠানো হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ। এর পরপরই শ্রমবাজারটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। সাত বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সাল থেকে শর্ত সাপেক্ষে আবারও বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া শুরু করে সৌদি আরব। শর্ত, একজন নারী শ্রমিক পাঠানো হলে তিনজন পুুরুষ শ্রমিক যেতে পারবেন সেখানে। কিন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতায় নারী শ্রমিকরা আগ্রহী নন সৌদি আরব যেতে। এ কারণে আটকে আছে বিশালসংখ্যক পুরুষ শ্রমিকের সৌদি যাত্রা। কয়েক লাখ শ্রমিকের সুযোগ থাকলেও শর্তের কারণে গত বছর দেশটিতে গেছেন মাত্র দেড় লাখ নারী ও পুরুষ। দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাঁচ বছর ধরেই পুরুষ শ্রমিক রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। ২০০৮ সালে সৌদি আরব বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া বন্ধ করার পর বিকল্প বাজার হয়ে উঠেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু নিরাপত্তার অজুহাতে ২০১২ সালে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। বহু দেনদরবারের পরও খোলেনি আমিরাতের শ্রমবাজার। তবে কী কারণে দেশটির সরকার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না তা জানতেই পারছে না বাংলাদেশ। এর পরও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) শ্রমবাজার শিগগিরই খুলে যাবে বলে বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। চলতি মাসে তার সফরেরও কথা রয়েছে ইউএইতে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরও বাজার চালু না হওয়ায় আশাবাদী হতে পারছে না কেউই। সাধারণ শ্রমিকদের ধারণা, বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই ইউএইতে যেতে পারছেন না বাংলাদেশিরা। এ সুযোগে আমিরাতের স্থাপনা নির্মাণ, কনস্ট্রাকশন, ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন সেক্টরে ভারত ও নেপালের শ্রমিকরা নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশিদের সুযোগগুলো। ২০০৮ সালে যে আমিরাতে চার লাখ শ্রমিক গিয়েছিলেন, সেখানে গত বছর গেছেন মাত্র আট হাজার। এ চিত্র শুধু সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতেই নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারই সংকুচিত হয়ে আসছে। ২০০৭ সাল থেকে টানা আট বছর বন্ধ থাকার পর কুয়েতে শ্রমবাজার আবার চালু হয়েছে। গত বছর সেখানে ৩৯ হাজার কর্মী পাঠাতে পেরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু টানা বন্ধ থাকার সময়টিতে কুয়েতে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের অনেকখানিই দখল করে নিয়েছে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভারত ও ফিলিপাইন। বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া নিয়ে চলছে নানা খেলা। চিহ্নিত সিন্ডিকেটের কারণে বারবার সুযোগ তৈরি হয়েও শ্রমিক পাঠানো যাচ্ছে না। রাঘব-বোয়ালদের এই সিন্ডিকেট একাই নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে পুরো বাজারটি। তারাই কবজায় রাখতে চাইছে শ্রমিক পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে কিছু ভিসা উচ্চ মূল্যে বিক্রির অভিযোগও আছে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় বলয় বিছিয়ে রাখা এই সিন্ডিকেটের কারণে পুরো বাজারই পড়েছে অচলাবস্থায়। ১৫ লাখ শ্রমিক নেওয়ার মালয়েশিয়ার ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই তা স্থগিত করার পেছনেও সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেন কেউ কেউ। সূত্র জানায়, বর্তমানে ১৬০টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। কিন্তু সৌদিসহ মাত্র ১৪টি দেশে যতসংখ্যক কর্মী যান, এর ২০ ভাগের এক ভাগও যাচ্ছেন না বাকি দেশগুলোয়। সৌদি আরব ও আমিরাতের শর্তের জালে আটকে থাকা, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে কারসাজি, সরকার পতনের আন্দোলন ও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের কারণে ইরাক ও লিবিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ থাকা, চাহিদা থাকা রোমানিয়া, গ্রিস, ইতালির অভ্যন্তরীণ সংকট ক্রমেই সংকুচিত করে দিচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে। নতুন শ্রমবাজার খোঁজার উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো সাফল্য আসেনি। এ অবস্থায় দেশের প্রায় এক হাজার ২০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে গুটিকয় ছাড়া বাকিরা কর্মহীন। পাশাপাশি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রেমিটেন্সের প্রবাহে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতে এখন সবচেয়ে অস্থির সময় চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজারগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এসব বন্ধ বাজার নতুনভাবে খোলার চেষ্টা হলেও সফল হয়নি সরকার। ফলে সৌদিসহ বেশ কয়েকটি শ্রমবাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। কূটনৈতিক ব্যর্থতা সেই অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। দিন যত যাচ্ছে ক্রমেই সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে আমাদের বৈদেশিক শ্রমবাজার।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কুয়েতের মতো উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই ওই সব দেশ প্রবাসী শ্রমিক নিচ্ছে না। আবার অনেক প্রবাসী শ্রমিক ওই সব দেশ থেকে ফিরেও আসছেন। পশ্চিমা দেশগুলোতে অভিবাসীবিরোধী মনোভাব তৈরি হওয়ার কারণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এসব কারণে প্রবাসী আয় কমেছে। এটিকে খুবই দুশ্চিন্তার বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ‘কেননা প্রবাসী আয়ের জন্য আমরা অন্য দেশের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপরই নির্ভর করে থাকি। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর যদি নির্ভরতা কমাতে হয়, তবে আমাদের বিকল্প জনশক্তির বাজার খুঁজতে হবে।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘স্বল্পমেয়াদি কোনো উদ্যোগ নিয়ে আয় বাড়ানো যাবে না। বেশি শ্রমিক আছে এমন দেশের দূতাবাসকে সক্রিয় হতে হবে। এ ছাড়া হুন্ডি ও ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। আর পুরনো ধ্যানধারণা নিয়ে বসে না থেকে নতুন নতুন শ্রমবাজার ও দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে হবে। বিশ্বে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ক্রমেই কমে আসছে তা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর