শুক্রবার, ৫ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

সেই ষড়যন্ত্রকারীরা শনাক্ত

তদন্ত গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

সেই ষড়যন্ত্রকারীরা শনাক্ত

২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিল ও আশপাশের এলাকায় রাতভর ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব চালানো মামলার তদন্ত কাজ থমকে রয়েছে। দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের গ্রিন সিগন্যাল পেলেই তদন্ত কাজ স্বাভাবিকভাবে চলবে।

সূত্র জানায়, ওই ঘটনার মধ্যদিয়ে সরকার উত্খাতের মতো ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের সব পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতারা শনাক্ত হয়েছে। তাণ্ডবের ঘটনায় ঢাকায় ৫৩টি এবং সারা দেশে আরও ৩০টি মামলা হয়। গত পরশু পর্যন্ত ঢাকায় তিনটি এবং চট্টগ্রামে একটি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। বাকি ৭৯টি মামলার তদন্ত কাজ অনেকটাই হিমাগারে রয়েছে। পুলিশ বলছে, গ্রিন সিগন্যাল পেলে মামলার তদন্ত কাজ চলবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত ডিএমপি কমিশনার মনিরুল ইসলাম সম্প্রতি গণমাধ্যম কর্মীদের  জানান, সেদিন যেহেতু শাপলা চত্বরে অনেক জনসমাগম হয়েছিল, তাই প্রত্যেককে চিহ্নিত ও তাদের প্রত্যেকের ভূমিকা খুঁজে  বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে পুলিশ। এ জন্যই মামলার তদন্তে সময় লাগছে। জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৫ মে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি, রাসুল (সা.) ও ইসলামের অবমাননা বন্ধে আইন পাসসহ ১৩ দফা দাবিতে রাজধানীর শাপলা চত্বরে সমাবেশের ডাক দিয়ে তাণ্ডব শুরু করে হেফাজতে ইসলাম। হাজার হাজার হেফাজত অনুসারী পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, বায়তুল মোকাররম মার্কেটে পবিত্র কোরআন শরিফ পোড়ানো, আওয়ামী লীগ অফিস পোড়ানো, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাটের ঘটনা ঘটায়। সহিংস তার পর ২০১৩ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, কলাবাগান, শেরেবাংলানগর ও রমনা থানায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৫৩টি মামলা দায়ের করা হয়। পরদিন নারায়ণগঞ্জে তিনটি এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুরসহ কয়েকটি জেলায় আরও ৩০টি মামলা হয়। ঘটনার পর হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা জুনাইদ বাবুনগরী, সাবেক এমপি মুফতি ওয়াক্কাস, মুফতি হারুন, মুফতি মমিনুল ইসলামসহ ১০ শীর্ষ নেতা এবং আরও ৭৭ কর্মী গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাদের কয়েকজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এরপর এসআই শাহজাহান হত্যা মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়াকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ১৮ দলের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মুফতি ওয়াক্কাসকে গ্রেফতার করে ডিবি। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, হেফাজতের মামলার তদন্তে সাক্ষ্য-প্রমাণের অনেক অভাব রয়েছে। অনেকেই এ ব্যাপারে মুখ খুলতে চায় না। আবার সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে সরকারের বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এ কারণে উচ্চ পর্যায় থেকে গ্রিন সিগন্যাল মিললেই কেবল এই মামলাগুলোর তদন্ত শুরু করা সম্ভব। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, মুফতি হারুন ও মুফতি মমিনুল ইসলামসহ চার-পাঁচজনকে  গ্রেফতার করা হয়। মুফতি ওয়াক্কাস রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে ৫ মে হেফাজতের সমাবেশের সময় মঞ্চে উপস্থিত থেকে নির্দেশনা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। ওই নাশকতায় জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম,  নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট ও মুসলিম লীগের সম্পৃক্ততারও তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া হেফাজতের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এবং বিএনপির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধেও এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার তথ্য-প্রমাণ মেলে। হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা জুনাইদ বাবুনগরী, মুফতি ওয়াক্কাস ও মামুনুল হককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে সেদিনের সহিংসতার অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার ৫৩টি মামলার মধ্যে রমনা থানার একটি ও কলাবাগান থানার দুটি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অন্য মামলাগুলোর মধ্যে থানা পুলিশ ৩৫টি ও গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ১৫টির তদন্ত করছে। সবচেয়ে বেশি মামলা আছে পল্টন থানায় ২৩টি। এ ছাড়া মতিঝিলে দুটি, রমনায় দুটি, শাহবাগে তিনটি, যাত্রাবাড়ীতে তিনটি এবং ধানমন্ডি থানায় রয়েছে একটি মামলা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মামলার তদন্ত এবং প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন কর্মকর্তারা। গ্রিন সিগন্যাল পেলেই মামলাগুলো চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

অপারেশন শাপলা : ২০১৩ সালের ৫ মে গভীর রাতে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিপির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনী ‘অপারেশন শাপলা’ নাম দিয়ে হেফাজতের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। ওই অভিযানের আগে ও পরে এক পুলিশ সদস্যসহ ১১ জন নিহত হন বলে পুলিশ স্বীকার করে। তবে হেফাজতে ইসলাম, বিএনপিসহ কয়েকটি সংগঠন দাবি করে, রাতের অভিযানে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার ২০১৩ সালের ১০ জুন ৬১ জন নিহত হয়েছে বলে প্রতিবেদনও দেয়। ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্রকে গ্রেফতারের পর হেফাজতের সমাবেশে ‘কথিত নিহতদের’ তালিকা উদ্ধার করে ডিবি। পুলিশ জানায়, ওই তালিকাটি ছিল ‘সম্পূর্ণ ভুয়া’। তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ডিবির তদন্তাধীন ১৫ মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে ভুয়া নিহতের তালিকা নিয়ে তদন্তের বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে। অধিকার কার্যালয় থেকে উদ্ধার করা আলামতের সূত্র ধরে নতুন কিছু তথ্যও পাওয়া গেছে। এদিকে সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ আশপাশ এলাকায় হেফাজতের তাণ্ডবে নির্দেশদাতাদের চিহ্নিত করা গেছে। প্রত্যেককে চিহ্নিত করে এখন তাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং তাদের প্রত্যেকের ‘রোল’ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে পুলিশ। চার্জশিট দিতে এজন্যই সময় লাগছে।

যারা আসামি : হেফাজত নেতাদের মধ্যে যারা বেশির ভাগ মামলায় আসামি হয়েছেন তারা হলেন মহাসচিব মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী, মুফতি ওয়াক্কাস, চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি মাওলানা মইনুদ্দিন রুহী, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ফরিদ উল্লাহ, মাওলানা শামসুল আলম, মাওলানা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, মাওলানা তাজুল ইসলাম, মাওলানা জুলফিকার জহুর, জামায়াত নেতা মাওলানা হাফিজুর রহমান, হাজী জালাল উদ্দিন, এম এ কাসেম ফারুকী, হেফাজত নেতা মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, মুফতি ফখরুল ইসলাম, মাওলানা মহিউদ্দিন, বগুড়া জেলার সদস্যসচিব ও ইসলামী ঐক্যজোটের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলুল করিম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা হেফাজতের সভাপতি আল্লামা মনিরুজ্জামান সিরাজী, নাসিরনগর থানার সভাপতি মাওলানা সামসুদ্দিন, নরসিংদী সভাপতি শওকত হোসেন সরকার ও কুমিল্লার মুরাদনগর থানা  হেফাজতের প্রধান মুফতি আমজাদ হোসেন প্রমুখ।

সর্বশেষ খবর